যুদ্ধবিরতির সময়ও ইসরায়েলি হামলা থামেনি

ইসরায়েল ও গাজার মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির সময়ও হামলা থামেনি। দুই পক্ষই হামলার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে। এদিকে মিসরের মধ্যস্থতায় কায়রো আলোচনায় সমন্বিত যুদ্ধবিরতির খবর নাকচ করে দিয়েছে দুই পক্ষই। ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবিগদর লিবারম্যান বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবর সঠিক নয়।’ অন্যদিকে হামাস বলছে, কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি। তবে মিসরে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার খবর বেরিয়েছিল, ইসরায়েল ও গাজা সমন্বিত যুদ্ধবিরতিতে ‘সম্মত’ হয়েছে। মিসরের মধ্যস্থতায় কায়রোতে আলোচনা শেষে ওই যুদ্ধবিরতি হয় বলে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন। খবর এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি ও আল-জাজিরার।
এর আগে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের আহ্বানে গতকাল পাঁচ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ইসরায়েল ও হামাস।৭ জুলাই থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় গতকাল পর্যন্ত ১০ দিনে ২২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত এক হাজার ৭০০ জন।
প্রতিবেশী মিসরের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষ গতকাল কায়রোয় আলোচনায় বসে। আলোচনার একপর্যায়ে ইসরায়েলি একজন কর্মকর্তা যুদ্ধবিরতিতে ‘সম্মত’ হওয়ার খবর জানান।ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। কাল (আজ শুক্রবার) থেকে তা কার্যকর হবে।’ তবে রয়টার্সের খবরেই বলা হয়, মিসরে ইসরায়েলের শুধু জ্যেষ্ঠ নেতারা যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসরায়েলি শীর্ষ নেতারা যুদ্ধবিরতির বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।
কিন্তু গাজায় ক্ষমতাসীন হামাস ওই খবর অস্বীকার করে। হামাস জানায়, কায়রোর আলোচনায় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনা এগিয়ে চলছে। মিসরের আলোচনায় অংশ নেয়নি হামাস। ওই আলোচনায় যোগ দেওয়া ফিলিস্তিনি সংগঠন ফাতাহর প্রতিনিধি আজ্জা আল-আহমাদ আল-জাজিরা টেলিভিশনকে বলেন, কায়রোর আলোচনায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মতৈক্য হয়নি, তবে আলোচনা চলছে। সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি: গাজার বাসিন্দাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের সুযোগ দিতে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় দুই পক্ষ। ইসরায়েল এটিকে ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ বলছে৷ গাজায় জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা কার্যক্রমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংক্ষিপ্ত এই যুদ্ধবিরতি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তাঁদের জরুরি কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। এই কার্যক্রমের মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
গাজার বাসিন্দারা সংক্ষিপ্ত এই যুদ্ধবিরতির সময় নিত্যপণ্য সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করেন। এ সময় গাজার প্রধান সড়কগুলোতে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকরের দুই ঘণ্টার মধ্যেই গাজা থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে অন্তত তিনটি রকেট ছোড়া হয়েছে। পাল্টা অভিযোগে হামাস বলেছে, যুদ্ধবিরতির সময় গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েল-হামাস সংক্ষিপ্ত এই যুদ্ধবিরতি গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকেল তিনটায় শেষ হয়। এর মধ্যেই মিসর থেকে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতিতে ‘সম্মত’ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মিনিট কয়েক আগেই গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলায় তিন ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হন। ফিলিস্তিনের জরুরি সার্ভিসের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা গতকাল জানান, ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলায় তিনজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি চারজন গুরুতর আহত হন। হামলায় ইসরায়েলের ছয়টি ট্যাংক অংশ নেয়।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৭ জুলাই ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ নামে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। ওই অভিযানে গতকাল পর্যন্ত ২২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন অন্তত এক হাজার ৭০০ জন। এঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
যুদ্ধবিরতির জন্য সব উপায় ব্যবহার করা হবে: ওবামা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত বুধবার হোয়াইট হাউসে বলেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান সহিংসতার অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র তার সব কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও সম্পর্ক ব্যবহার করবে।
দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য মিসরের প্রচেষ্টাকে ওয়াশিংটন সমর্থন করে উল্লেখ করে ওবামা বলেন, কার্যকর যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তার অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। ওই অংশীদারদের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রেখে চলছে হোয়াইট হাউস।
ওবামা বলেন, গাজা থেকে ছোড়া রকেট হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। কিন্তু গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানির বিষয়টিও দুঃখজনক।
‘ইসরায়েল বিশ্বসম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে’ -বিল ক্লিনটন
বিশ্বসম্প্রদায় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার বিষয়ে ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় উপর্যুপরি ইসরায়েলি বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে এই মন্তব্য করলেন তিনি। খবর এএফপির।
বিল ক্লিনটন বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। গত বুধবার তিনি ভারতের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন।
বিল ক্লিনটন বলেন, একটি টেকসই শান্তি প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে ইসরায়েল নিজেকে বিশ্বসম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এটা দীর্ঘমেয়াদে দেশটির জন্য ভালো কিছু নয়। স্বল্প বা মধ্যমেয়াদে হামাস ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকদের হত্যা করতে বাধ্য করার মাধ্যমে দেশটিকে সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর করে তুলছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্লিনটন বলেন, হামাস একটি কৌশল নিয়েছে। সেটি হলো, তারা তাদের বেসামরিক লোকদের হত্যা করতে ইসরায়েলকে বাধ্য করবে, যাতে করে বাকি বিশ্ব ইসরায়েলের নিন্দায় সরব হয়। আবার ইসরায়েল রকেট হামলার মুখে হাত গুটিয়ে বসেও থাকতে পারবে না।
ঐতিহাসিক ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন। বর্তমান সংকট নিরসনে তিনি একটি কার্যকর সংলাপে বসতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানান। ক্লিনটন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুই পারেন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি নিবিড় শান্তিচুক্তি করতে। তাঁর এটা করা উচিত।’ সেটা করলে শতকরা ৬০ ভাগ ইসরায়েলিই নেতানিয়াহুকে সমর্থন করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইসরায়েলকে স্থল অভিযান বন্ধ করতেই হবে: আব্বাস
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজায় স্থল অভিযান বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আরও রক্ত ঝরবে। সহিংসতা বন্ধের চেষ্টা জটিল হয়ে উঠবে।
ইসরায়েলের হামলায় গত ১১ দিনে গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৫৮ জনে পৌঁছেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার মিসরের রাজধানী কায়রোতে সে দেশের বৃদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় আব্বাস স্থল অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান। মিসরের সংবাদ সংস্থা মিনার বরাত দিয়ে এএফপিতে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আব্বাসের ওই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা আগেই গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হয়েছে। আজ শুক্রবার চালানো ইসরায়েলের স্থল অভিযানে শেজাইয়াহ নামের এক ব্যক্তিসহ সাতজন নিহত হয়েছেন।
জরুরি বিভাগের মুখপাত্র আশরাফ আল কুর্দ জানান, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে এক শিশুও রয়েছে। এ নিয়ে ১১ দিনে গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৫৮ জনে পৌঁছাল।
গতকাল আব্বাস মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সঙ্গে দেখা করেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জঙ্গি দল হামাসের মধ্যে সহিংসতা নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আব্বাস ওই সফর করেন। আজ শুক্রবার আব্বাস তুরস্কে যাবেন। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সেখান থেকে তিনি বাহরাইন ও কাতারে যাবেন।
মানবাধিকার সংস্থার মতে, গাজায় হামলার শিকার ৮০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় এক হাজার ৯২০ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।
গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ফিলিস্তিন-শাসিত গাজার নিয়ন্ত্রক হামাস ও ইসরায়েল পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। তবে যুদ্ধবিরতির সময়ও হামলা বন্ধ হয়নি।
ইসরায়েলের অভিযোগ, সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে গাজা থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে অন্তত তিনটি রকেট ছোড়া হয়েছে। পাল্টা অভিযোগে হামাস বলেছে, যুদ্ধবিরতির সময় গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় মর্টার শেল ছুড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

No comments

Powered by Blogger.