ঝুঁকিপূর্ণ জীবন ও জীবিকা

আজ ২৫ মে। ২০০৯ সালের এ দিনে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশ ও ভারতের একাংশে আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়ে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩৯ লাখ মানুষের মধ্যে খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশির সত্তরোর্ধ্ব ছকিনা খাতুনের ক্ষতি কখনো পূরণ হওয়ার নয়। এই বৃদ্ধা হারিয়েছেন তাঁর ছোট মেয়ে ও দেবরকে। এ ছাড়া সুন্দরবনের গোলপাতা ও কাঠ দিয়ে তৈরি তাঁর দোচালা ঘরটি ১২০ কিলোমিটার গতিবেগে আসা ঝড়ের শুরুতেই খড়কুটোর মতো উড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর ফসলি জমি এবং মরে যায় তাঁর গবাদিপশু। সহায়-সম্পদ ও আপনজন হারানোর ক্ষত ছকিনা খাতুন আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর ছকিনার মতো এ রকম অসংখ্য হতদরিদ্র মানুষ আইলা–আক্রােন্তর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। আইলার ধ্বংসলীলায় বাংলাদেশের যে কয়েকটি এলাকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা অন্যতম। সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা এ জনপদ সেদিন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এখনো এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। সেই জোড়াতালির বেড়িবাঁধ, খুপরিতে মানুষের বসবাস, অনাবাদি ফসলি জমি, আয়-উপার্জনক্ষম পেশার অভাবের ফলে অন্যত্র কাজের সন্ধানে চলে যাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোর মেরামত সংস্কারের অভাবে পুরো জনপদ এখনো যেন সেই ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত কার্যক্রমের অভাব এখনো দৃশ্যমান।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। দাতা সংস্থানির্ভর এনজিও কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে। একটু জোয়ারের পানিতেই অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে৷ ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘসূত্র ও তৎসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভৌত অবকাঠামো, বিশেষ করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি এবং সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমও এখনো সেভাবে দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইসলামিক রিলিফ, রূপান্তরসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জীবন-জীবিকা পুনর্গঠন, ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, উচুঁকরণ ও ছোটখাটো কিছু রাস্তাঘাট মেরামত করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মানুষের কাজ নেই, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি নেই, বসবাসের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ঘর নেই, অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। এ রকম অসংখ্য ‘নেই’-এর মধ্যে বসবাস করছে এখানকার মানুষ। কাজের সুবাদে সাম্প্রতিক সময়ে ওই অঞ্চলে গিয়ে আমি দেখেছি এসব মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র। সম্প্রতি প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত সংস্থার জরিপ মতে, আইলা-পরবর্তী চার বছরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে হতদরিদ্র লোকের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ বেড়েছে এবং ৪৩ শতাংশ লোক মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র ও হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া, চিংড়ি চাষ তুলনামূলকভাবে সক্ষম, সচ্ছল ও পেশিশক্তিসম্পন্ন মানুষদের লাভজনক বযবসায় পরিণত হওয়ায় দরিদ্র ও সহায়-সম্বলহীন মানুষদের এ পেশা থেকে আয়ের সুযোগ যৎসামান্য।
আবার, চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকায়নে এবং কাজের সন্ধানে প্রতিদিন মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ২০১৩ সালের জরিপ মতে, আইলা-পরবর্তী সময়ে খুলনা এবং তৎসংলগ্ন সাতক্ষীরার প্রায় এক লাখ ২০ হাজার লোক বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমরা দেখেছি বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য সংগ্রাম করা একজন গর্ভবতী নারীকে, যিনি প্রতিদিন প্রায় দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এক কলস বিশুদ্ধ পানি আনেন। আর রোগবালাই, বিশেষ করে পানিবাহিত রোগ এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। আইলাবিধ্বস্ত এ জনপদে এখন দরকার বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তার সুষ্ঠু ও সময়মতো বাস্তবায়ন। দেশের এ অঞ্চলটির জন্য বিশেষ বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। সমন্বিত উন্নয়ন ও সবার জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে এই অঞ্চলের সাংসদদের নিয়ে ‘বিশেষ সংসদীয় ককাস’ গঠন করা যেতে পারে, যাঁরা এ এলাকার সমস্যা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ করবেন। এ ছাড়া বহুদিনের পুরোনো বেড়িবাঁধগুলোর টেকসই সংস্কার ও উন্নয়ন দরকার, পাশাপাশি বেড়িবাঁধসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন। তুলনামূলকভাবে অধিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ, গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিতে হতদরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্প খরচে ঘর ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধাদি নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। সুন্দরবনকে তার মতো করে বেড়ে উঠতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে হবে।
মোহাম্মদ আলমগীর: উন্নয়ন যোগাযোগকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.