হত্যাকারী শনাক্ত ও গ্রেফতার- এবার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হককে দুর্বৃত্তরা গত মঙ্গলবার প্রকাশ্য দিবালোকে প্রথমে গাড়িতে গুলি চালিয়ে, অতঃপর গানপাউডার দিয়ে গাড়িটি জ্বালিয়ে যে নৃশংসতায় হত্যা করেছে, সেই শোকাবহ স্মৃতি মানুষের মধ্যে এখনও জ্বলজ্বল করছে। তবে আশার কথা, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শুধু শনাক্তই করা হয়নি, তাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ থেকে অপরাধীদের শনাক্ত করার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে আটককৃত আটজনের মধ্যে ছয়জনই সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। আরও নিশ্চিত হওয়া গেছে, একরামুল হককে প্রথম গুলিটি করেছিল ফেনী-২ আসনের এমপি নিজামউদ্দিন হাজারীর মামাতো ভাই আবিদুল ইসলাম ওরফে আবিদ।

একরাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে- এ খবর নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক। দেশে অপহরণ-গুম-খুনের ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। হত্যার মোটিভও থেকে যাচ্ছে অজ্ঞাত। একরাম হত্যাকাণ্ড এক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রম বটে। বস্তুত অপরাধ নির্মূলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধীকে শনাক্ত করার বিষয়টি। অপরাধী যখন কোনো অপরাধ করে, তখন সে ধরেই নেয় যে, সে ধরা পড়বে না। অপরাধী যদি নিশ্চিতভাবে জানত যে, অপরাধ করার পর সে ধরা পড়বে, তাহলে অপরাধ সংঘটনে সে মানসিক জোর পেত না। সুতরাং দেশের আইনশৃংখলা বাহিনীগুলোকে এমন এক অবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে অপরাধীরা উপলব্ধি করতে পারে যে, অপরাধ করলে আইনের হাত তাকে স্পর্শ করবেই। প্রকৃতপক্ষে, পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোয় অপরাধের মাত্রা কম হওয়ার এটাও এক বড় কারণ। সেখানকার পুলিশি ব্যবস্থা এত নিñিদ্র যে, অপরাধী সেখানে শনাক্ত ও গ্রেফতার হবেই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি হচ্ছে অপরাধ নির্মূলের দ্বিতীয় ধাপ। সুতরাং আমরা যারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকেই অপরাধ নির্মূলের প্রধান প্রতিরোধক বলতে অভ্যস্ত, তাদের বুঝতে হবে, শত শত কিংবা হাজার হাজার অপরাধীকে অশনাক্ত রেখে দু-চারজনের শাস্তির ব্যবস্থা করলেই সমাজ থেকে অপরাধ দূর হবে না।
আমরা একটা বিষয় দেখতে পাচ্ছি- চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজন বা ক্যাডারদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় এক মন্ত্রীর আত্মীয় এবং ফেনীর ঘটনায় এমপির মামাতো ভাইয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কেন এমন হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারি না। ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসনে মোটামুটি সফল হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়েছিল। এ ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের কতিপয় গডফাদারের কুকীর্তিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, গফরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উত্থান ঘটেছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী গডফাদারদের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের প্রশ্রয়ই দিয়েছিলেন বলা যায়, যার খেসারত দিতে হয়েছিল নির্বাচনে। আমরা লক্ষ্য করছি, সেই আমলের গডফাদাররা এখনও বহাল তবিয়তেই আছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন, ফেনীর এমপি নিজামউদ্দিন হাজারীর মামাতো ভাই একরামকে উদ্দেশ করে গুলি ছুড়েছে কোন সাহসে? তার ভাই এমপি, এটাই তার সাহসের উৎস? এমপি বা মন্ত্রীর আÍীয় বা ক্যাডার যে আরও হত্যাকাণ্ড ঘটাবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আসলে এভাবে আর চলতে পারে না দেশ। আমরা শুধু একের পর এক হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেই যাব? অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাবে একসময়? একরামের হত্যাকারীদের এবার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহলকে নিতে হবে জিরো টলারেন্স নীতি।

No comments

Powered by Blogger.