আফগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? by ফাতেমা আবেদীন

আগামীকাল শনিবার আফগানিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এটিই দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন দেশটির দীর্ঘ এক যুগের শাসক হামিদ কারজাই। একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে প্রাদেশিক নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

>>কাবুলে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে যাওয়ার পথে সড়কে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা। গত ২৯ মার্চ কমিশন কার্যালয়ে তালেবান হামলা চালায়। ছবি: রয়টার্স
সাধারণত আফগানিস্তানে নির্বাচনের সময় বাইরে থেকে আসা ফ্লাইটগুলোয় বিদেশি পরামর্শক, পর্যবেকক্ষক, কূটনীতিক ও সাংবাদিকে ভরপুর থাকে। কিন্তু এবারের দৃশ্য অন্য রকম। এখন বাইরে থেকে যেসব ফ্লাইট আসছে, সেগুলো প্রায়ই যাত্রীশূন্য থাকছে। উল্টো বিদেশি সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক ও কূটনীতিকেরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। মূলত স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় তালেবানের হামলার পর বিদেশিরা দেশটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
গত জানুয়ারি মাসে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পরই তালেবান বিদ্রোহীরা নির্বাচন বানচালের অঙ্গীকার করে। একের পর এক হামলা চালানো শুরু করে। যদিও তারা প্রেসিডেন্ট পদের ১১ প্রার্থীর ওপর কোনো হামলা চালায়নি। কিন্তু বিদেশিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গত ২০ মার্চ রাজধানী কাবুলের সেরেনা হোটেলে হামলা চালায় তালেবান। এতে পাঁচজন আফগান ও চারজন বিদেশি নাগরিক নিহত হন।
তালেবান দমনে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক অভিযানও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের চলে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। আফগানিস্তানের এর আগের নির্বাচনগুলোর অন্যতম পর্যবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট কাবুলে তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। সেরেনা হোটেলে হামলার পর সংস্থাটি এই সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার কারণে পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান দি ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট এবারের নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না। অথচ গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংস্থাটি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সার্বিক সহায়তা দিয়েছিল।
আফগানিস্তানের ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আহমাদ নাদের নাদেরি জানান, নির্বাচনের সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল নির্বাচনকেন্দ্রিক সার্বিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করেছে। নাদেরি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের এভাবে সরে যাওয়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে হলে ন্যূনতম পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু নিরাপত্তাসংকট প্রকট আকার ধারণ করায় পর্যবেক্ষণ-প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে।
নাদেরি বলেন, দাতা দেশগুলোর ন্যূনতম চাওয়া হচ্ছে নির্বাচন অপেক্ষাকৃত অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। অনেক দেশই এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তারা আফগানিস্তানে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেবে।
কাবুলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবেই কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ছাড়াও অন্য কর্মকর্তাদেরও প্রায় এক মাস আগে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনী নিরাপত্তা কমিটির প্রধান সালেম এহশাস বলেছেন, ভোটাররা সব কয়টি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন এমন নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। তবে ৯০ শতাংশ কেন্দ্রকে নির্বাচনী সহিংসতার বাইরে রাখতে পারার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ছয় হাজার ৭৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে নিরাপত্তাজনিত কারণে ৭৭৮টি কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত নির্বাচনে এর চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্র সহিংসতা ও তালেবান হামলা এড়াতে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তিনি সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তাঁর প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়নি বিদেশি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে আফগানিস্তানের নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র নূর মোহাম্মদ নূর এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, মোট এক হাজার ৫৫০টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে সম্মত হয়েছে। গত সপ্তাহেই ১২০টি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এক হাজার ৪০০ প্রতিনিধিকে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। আফগানিস্তানের নির্বাচন জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সার্কের পক্ষ থেকেও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারাও প্রতিনিধি পাঠাতে সম্মত হয়েছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষকেরা পূর্ণোদ্যমে অংশ নেবেন। তবে স্থানীয় বিশ্লেষকেরা দাবি করেন, দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটি অবকাঠামো রয়েছে মাত্র। আক্ষরিক অর্থে কোনো কার্যক্রম নেই। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমনটিই হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই আফগানিস্তানে অবস্থানরত জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের অধিকাংশই ছুটিতে রয়েছেন। অনেককে ছুটি নিতে উৎসাহিতও করা হয়েছে।
বিদেশিদের এই চলে যাওয়া শুধু যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ওপর প্রভাব ফেলছে তা নয়, দেশের ব্যবসা-বাজ্যের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশটির একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল সেরেনা এখন প্রায় জনশূন্য। হামলার আগে হোটেলটির প্রতিটি কক্ষ পূর্ণ ছিল। এখন তা অর্ধেকে নেমেছে। অথচ নির্বাচন-পূর্ব দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। আফগানিস্তানের অধিকাংশ বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস স্থগিত রয়েছে। শিক্ষকদেরও দেশ ত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিশেল স্মিথ বলেন, নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার আশঙ্কায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউনুস ফাকুর বলেন, সহিংসতার আশঙ্কায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের চলে যাওয়াটা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তবু ২০০৯ সালের চেয়ে অনেক বেশি ভোট পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন ফাকুর।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ এক জনসভায় দাবি করেন, কোনো সহিংসতা বা তালেবানি হামলা ভোটারদের ভোট দান থেকে বিরত রাখতে পারবে না। তাঁর মতো করেই ভাবছেন সাধারণ আফগানরা। তবে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস ও টোলোনিউজ

No comments

Powered by Blogger.