আফগানিস্তানের সামনে আরও কঠিন সময় by ব্রহ্মা চেলানি

আফগানিস্তান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে। ৩৫ বছরের যুদ্ধের পর দেশটির ঐক্য ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা আজ হুমকির মুখে। আফগানিস্তান কি তিন দশকের বেশি সময়ের জঙ্গিবাদ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের চক্র থেকে মুক্ত হতে পারবে?

আফগানিস্তানের ২০১৪-পরবর্তী দৃশ্যপটের আলোচনার মূল সুর দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ঘিরে: প্রথমটি হচ্ছে পাকিস্তান কী মাত্রায় আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করা অব্যাহত রাখবে। পাকিস্তান এ কাজটি করতে পারে যেসব উপায়ে, তার মধ্যে রয়েছে আফগান তালেবান ও তাদের প্রধান মিত্র হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাহিনীকে সহায়তা করা। এটি অবশ্য নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া তার সহায়তা আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ না করার সঙ্গে শর্তযুক্ত করবে কি না তার ওপর।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে কোনো ভূমিকা অব্যাহত রাখবে কি না। প্রেসিডেন্ট ওবামা যে আফগানিস্তানে তাঁর দেশের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে চান, তা আর গোপন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে কোনো সামরিক ঘাঁটি রাখতে চায় না বলে ২০০৯ সালে ওবামা যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা থেকে সরে গেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র একটি দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তির জন্য আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে কার্যত অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক ঘাঁটি বজায় রাখার সুযোগ করে দেবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি গোটানোর পর্ব চলার কথা থাকলেও এটি বরং ঘাঁটিবিষয়ক কৌশল নিয়ে নতুন খেলায় পরিণত হয়েছে। তবে চুক্তির শর্তগুলো চূড়ান্ত করতে পারলেও ওবামা বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে তা স্বাক্ষর করতে রাজি করাতে পারেননি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, মে মাসে নতুন আফগান প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই কেবল সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্থির করা সম্ভব হবে।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল কী হবে, তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচনের আটজন প্রার্থীই নিরাপত্তা চুক্তি সমর্থন করেন বলে দাবি করেছেন। তবু যুক্তরাষ্ট্র তাতে তেমন স্বস্তি না-ও পেতে পারে। কারণ, অতীতে এ প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরাসরি মার্কিন স্বার্থের বিরোধিতা করেছেন। কয়েকজন তো সাবেক এমনকি বর্তমান যুদ্ধবাজ নেতা।
আফগানিস্তানে যদি কিছু মার্কিন সেনা থেকে যায়, তবে তারা কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অনেক বড় একটি বাহিনীই গত ১৩ বছরে সুস্পষ্ট বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তার পরও সামরিক পরাক্রম প্রদর্শনের উপায় হিসেবে আফগানিস্তানে ঘাঁটি বজায় রাখার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে জোরালো দ্বিদলীয় সমর্থন রয়েছে। ইউক্রেনকে নিয়ে রুশ-মার্কিন উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সে সমর্থন আরও বেড়েছে। বস্তুত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আলোচনাকে খোলাখুলিই ইউক্রেনে রাশিয়ার কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে দেখিয়েছেন। রাইসের মতে, আফগানিস্তানে ১০ হাজারের নিচে মার্কিন সেনা রাখা হলে তা এ বার্তাই পাঠাবে যে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিতে খুব একটা আন্তরিক নয়। আর সে বার্তাটি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আরও শক্তিশালী করবে।
যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে স্পষ্টতই নিশ্চিত যে আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত রাখা তার নিজের স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আর বিদেশি বাহিনীর হাতে একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগের শিকার আফগানিস্তানের জন্য তার অর্থটা কী দাঁড়াবে? সেই ১৯৭৯ সাল থেকে যুদ্ধ চলছে আফগানিস্তানে। দেশটিতে সক্রিয় বিভিন্ন জাতির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সে বছরই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিপর্যকর আট বছরের সামরিক অভিযানের সূচনা করে। সোভিয়েতবিরোধী গেরিলাদের পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের দেওয়া অস্ত্র সহায়তা আর সোভিয়েত হস্তক্ষেপ—এ দুয়ে মিলে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ছড়াতে সহায়তা করে। পরবর্তী সময়ের মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ তাকে চাঙা রেখেছে। এর পরিণতিতে আফগানিস্তান এখন জাতিগত ও গোষ্ঠীগত ভিত্তিতে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে। দেশটির বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিগোষ্ঠী ও যুদ্ধবাজ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ছিটমহলের’ সংখ্যা বেড়ে চলায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংক্ষেপে বললে, আফগানিস্তানে বিদেশি হস্তক্ষেপ এ পর্যন্ত ইতিবাচক ফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এ কারণেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ নির্ধারকের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত পালাবদল সফলভাবে সম্পন্ন করা যাবে। এগুলো হচ্ছে:
১. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যাতে একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে নিতে আফগান জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
২. দেশের বিভিন্ন জাতিগত ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করায় কারজাইয়ের উত্তরসূরির সক্ষমতা। এটি হবে একটি দুরূহ কাজ, যা কেবল বিশ্বাসযোগ্য ও ব্যাপকভাবে শ্রদ্ধাভাজন একজন নেতার পক্ষেই সম্ভব।
৩. আফগানিস্তানের বহুজাতিক জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলায় সরকারের সফলতা।
সামনের নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত কীভাবে হয়, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তালেবানের সহিংসতা ও হুমকি-ধমকিতে খুব বেশিসংখ্যক নাগরিক ভোটদানে বিরত থাকলে নির্বাচনী ফলাফলের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এটি দেশটিকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। দেশের উদীয়মান নিরাপত্তা বাহিনী তা সামলাতে বেগ পাবে।
সত্যি বলতে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এ পর্যন্ত ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছে। তারা অনেক হত্যাচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। মোটের ওপর নিরাপদ রেখেছে রাজধানী কাবুলকে। কিন্তু অন্যদিকে আবার তালেবান বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সাহায্য হ্রাসের মার্কিন পরিকল্পনা এ বাহিনীর অগ্রগতিকে আরও দুরূহ করে তুলবে। সাহায্য হ্রাস পেলে বর্তমান আকারের বাহিনী টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তখন আফগান সরকারকে এতে কাটছাঁট করার চেষ্টা করতে হবে। সরকার এতে সফল হবে কি না, তা খুবই অনিশ্চিত। এসব কারণে বিদেশি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রাখার পক্ষে চাপ বাড়বে। যদিও তা দেশটিতে শান্তি আনবে, এমন সম্ভাবনা কম। বস্তুত আফগানিস্তানে সামরিক ঘাঁটি রেখে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা পাবে, তার তুলনায় জঙ্গিবাদ ও আঞ্চলিক যুদ্ধবাজ নেতাদের সঙ্গে নিচু মাত্রার কিন্তু দীর্ঘায়িত একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। তা ছাড়া সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ সব আশ্রয় আর আফগান বিদ্রোহের ‘কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ তো আসলে পাকিস্তানে। এ বিষয়টি ২০০১ সাল থেকেই আফগান তালেবান বাহিনীকে দমনে মার্কিন সেনাবাহিনীর চেষ্টাকে ব্যাহত করে আসছে।
এর সবই আমাদের একটি স্পষ্ট উপসংহারে পৌঁছে দেয়, আর তা হলো, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ অবশ্যই শেষ পর্যন্ত আফগানদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। তবে দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ ও মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য যে সুশাসনের সামর্থ্য প্রয়োজন, সে জন্য চাই বাইরের সম্পদ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্রহ্মা চেলানি: ভারতের নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.