ক্রিমিয়া নিয়ে ভোট ও ‘আমাদের মাথাব্যথা’ by হাসান ফেরদৌস

ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গত সপ্তাহে যে নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাবের ওপর ভোট গৃহীত হয়, বাংলাদেশসহ ৫৮টি দেশ তাতে ভোটদানে বিরত থাকে। ১০০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ও ১১টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে মোট দেশের হিসেবে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাশিয়ার নিন্দাই করেছে।

এমনিতে সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তার যে কূটনৈতিক গুরুত্ব আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ার দক্ষিণ অসেতিয়া প্রদেশ দখলের চেষ্টা করলে সাধারণ পরিষদ তার নিন্দা করেছিল। কিন্তু সেবার পক্ষে ১৪, বিপক্ষে ১১, এই সামান্য ব্যবধানে সেই নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কারণ, ১০৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। সে প্রস্তাবকে রাশিয়া তার পক্ষে জয় বলে দাবি করতে পারত, করেও ছিল; কিন্তু তার পরও অসেতিয়া দখলের চেষ্টা না করে তাকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ক্রিমিয়া প্রসঙ্গে যে ৫৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে, তার প্রায় সবই উন্নয়নশীল দেশসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রুপ অব ৭৭-এর সদস্য। এই গ্রুপের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ অধিকাংশ সময় সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুসারেই সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দিয়ে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ মানেই দুর্বল কবজি, খালি পকেট। তাদের একমাত্র যা আছে তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সে কারণে যেকোনো আন্তর্জাতিক ফোরামেই তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে তাদের এই সংখ্যার জোরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে থাকে। সব সময় যে কাজে লাগে তা নয়, তবে একলা লড়ার চেয়ে অনেকে মিলে লড়লে জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি, এতে ভুল নেই।
ক্রিমিয়ার প্রশ্নে দুই পুরোনো পরাশক্তি নতুন করে কাজিয়া শুরু করায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য তা বিব্রতকর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। একদিকে আমেরিকা, এখনো বিশ্বের এক নম্বর—কারও কারও মতে একমাত্র পরাশক্তি। কবজির জোর ও পকেটের রেস্ত, তার দুটোই কমতির দিকে, কিন্তু তাই বলে আমেরিকাকে উপেক্ষা করবে, এমন অবস্থার সৃষ্টি এখনো হয়নি। অন্যদিকে রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে লন্ডভন্ড অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ এই দুইয়ের কাউকেই অখুশি করতে চায় না। রুশ ভালুক যেভাবে ক্রিমিয়াকে নিজের হাতের থাবার নিচে নিয়ে এল, এদের অনেকের চোখেই তা হয়তো আগ্রাসী মনে হয়েছে। নীতির কথা বিবেচনা করলে তাদের রাশিয়ার বিপক্ষে, তাকে নিন্দা করে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার কথা। কিন্তু কূটনীতিতে কবে কে আবার নীতির কথা মাথায় রাখে! সেখানে জাতীয় স্বার্থটাই মুখ্য। অতএব, সে বিবেচনায় বাংলাদেশ যে গ্রুপ অব ৭৭-এর সঙ্গে সমন্বিতভাবে ভোটদানে বিরত থাকে, সেটাই সঠিক হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকা আশা করেছিল, বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশ ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসনের বিপক্ষে ভোট দেবে। অর্থাৎ ভোটটা আমেরিকার পক্ষেই যাবে। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত সে কথা মুখ ফুটে বলেও ফেলেছিলেন। সে কথার জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন, তা কারও কারও ভ্রুকুটির কারণ ঘটাতে পারে। মন্ত্রী বলেছেন, কে কী ভাবল, তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। জোটনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে নাক গলানো আমাদের কাজ নয়। অতএব, ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থেকে বাংলাদেশ ঠিক কাজই করেছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশও প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার বদলে ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়ার চোখে তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। অন্যের জমি দখলের কাজটা তো বাহবা পাওয়ার মতো কিছু নয়। ফলে নিন্দার বদলে মুখে কুলুপ এঁটে রাখা হলে তা তো মস্কোর পক্ষেই গেল।
তবে কেন ভোটদানে বিরত থাকলাম, তার ব্যাখ্যা হিসেবে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা নাক গলাই না’ বলে যে যুক্তি বাংলাদেশ এবং কোনো কোনো জোটনিরপেক্ষ দেশ দিয়েছে, তা খুব কার্যকর নয়। সিরিয়ায় আজ যা ঘটছে, প্রেসিডেন্ট আসাদের সরকারের চোখে তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুদানের দারফুর, কঙ্গো বা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে যা ঘটছে, তাও সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই তারা দাবি করে থাকে।
১৯৭১-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, অধিকাংশ ‘জোটনিরপেক্ষ’ দেশ তাকেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালাতে চেয়েছে। একাত্তরে এদের কাউকেই আমরা কাছে পাইনি। ১২ বছর আগে কসোভোর ঘটনাবলিকে সার্বিয়া ও রাশিয়া উভয়েই অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করেছে। কিন্তু আমরা এখন জানি, এর কোনোটাই কোনো এক দেশের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় নয়। মানুষের জীবন যখন বিপন্ন, তাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়, অতএব সে বিষয়ে আমরা নাক গলাই না,’—এ যুক্তি বোধ হয় ধোপে টেকে না।
এই ভোট নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অবস্থানের যে মৃদু সমালোচনা করেছেন, তার উত্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তাতেও কিছুটা খটকা জেগেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমেরিকা কী ভাবল বা ভাবল না, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই—কথাটা খুব যে কূটনীতিকসুলভ হয়েছে, তা বোধ হয় বলা যাবে না। কোনো হেজি পেজি দেশ আমেরিকা নয়। তাকে আমরা বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করি, আমেরিকাও আমাদের শত্রু ভাবে, তা কখনো শুনিনি। ফলে, এমন দেশের প্রতিক্রিয়া কী হবে, যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সে কথা মাথায় রাখা পরিণত কূটনীতিকের প্রমাণ।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কোনো কোনো ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকা প্রসন্ন নয়। সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার ফলাফল নিয়ে আমেরিকার সমালোচনা আমাদের ক্ষমতাসীন মহলের ভালো লাগেনি।
এ কথা ঠিক, অনেক ব্যাপারেই আমেরিকা বড় ভাইসুলভ ব্যবহার করে থাকে। কাজে-অকাজে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়। এর কোনোটাই আমাদের ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু তাই বলে সে দেশকে খরচার খাতায় লিখে দেব, তাও কোনো কাজের কাজ নয়। আমরা ছোট দেশ। আমেরিকা আমাদের পাশে থাকলে আমাদেরই লাভ। বস্তুত, আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছে, তা কোনো মৌল বিষয়ে মতভেদ থেকে নয়। আর যদি মতভেদ থেকেও থাকে, বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে তা ব্যাখ্যা করাই দক্ষ কূটনীতিকের কাজ। ভয় হচ্ছে, সেই দক্ষতার কিছুটা খামতি বোধ হয় থেকেই যাচ্ছে।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.