কী পেল আওয়ামী লীগ?

পাঁচ পর্বে দেশের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পরিসমাপ্তি হয়েছে। সাকল্যে ৪০ দিনের ব্যবধানে সম্পন্ন এই নির্বাচনের প্রায় পুরো ফলই এখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। অঙ্কের হিসাবে এই শিরোনাম নির্ভুল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই বিজয় কীভাবে অর্জিত হলো এবং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হলো কি না, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। উপরন্তু বিএনপির ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেটাও দেখার বিষয়। নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যতের জন্যই বা এই নির্বাচন কতটা ইতিবাচক হবে? কাগজে-কলমে উপজেলা নির্বাচন দলভিত্তিক নয়, কিন্তু আমরা এও জানি যে বাস্তবে এই নির্বাচনের প্রার্থীরা দল-সমর্থিত হন, প্রচার কার্যত হয় দলভিত্তিক এবং এই বিষয়ে দলগুলো কোনো রকম রাখঢাক করে না। সাধারণভাবে বিবেচনা করলে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের কারণ নেই। কেননা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা সীমিত, তদুপরি দফায় দফায় এর কাঠামো ও ক্ষমতা সংশোধনের পর পরিষদগুলো নামেমাত্র স্থানীয় সরকারের বিষয়, কার্যত তা স্থানীয় সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। তদুপরি রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কর্তৃত্বের প্রশ্ন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি যতটা ইতিবাচক, ঠিক ততটাই নেতিবাচক যে তাঁদের কার্যপরিধি এবং ক্ষমতার প্রশ্নটি অমীমাংসিত রাখা।
সেনাশাসনের আমলে জেনারেল এরশাদের হাতে উপজেলা ব্যবস্থার উৎপত্তি। উদ্দেশ্য হিসেবে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হলেও অনেকেই এর মধ্যে সেনাশাসকের ক্ষমতা সংহত করার অসদুদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছিলেন। উপজেলা ব্যবস্থার মধ্যে পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের তৈরি করা বনিয়াদি গণতন্ত্রের ছায়া দেখতে পাওয়ার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়নি। তাই সে সময় অনেকেই একে ‘উপজ্বালা’ বলেও বর্ণনা করেছিলেন। সামরিক শাসনের বিরোধীরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং আন্দোলনের সময় এর বিলোপের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু একটি নির্বাচিত প্রশাসনিক কাঠামো, ইতিমধ্যে যার দুই দফা নির্বাচন হয়েছে এবং যেখানে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সেখানে এই কাঠামোর একটা উপযোগিতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থার বিলোপের সময় তা যে ভাবা হয়নি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, এর কোনো বিকল্প কাঠামো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেনি। পালাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এলেও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে যাঁদের আগ্রহ বেশি, তাঁদের হাতে উপজেলাই বলি, কি অন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানই বলি, তার বিকাশ সম্ভব নয়।
ফলে শেষ পর্যন্ত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরেই উপজেলার প্রত্যাবর্তন ঘটে ২০০৮ সালে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগ্রহ ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। যে আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠালগ্নে রাজনীতিবিদেরা এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, একই যুক্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে উপজেলার নির্বাচনে তাঁদের সায় ছিল না। এই টানাপোড়েনে শেষাবধি রাজনীতিবিদেরা জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের গোড়াতে, জাতীয় নির্বাচনের অব্যবহিত পরই, তৃতীয় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় নির্বাচনে আশাতীত ভোটারের উপস্থিতি ঘটলেও উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের উৎসাহ ছিল খুবই কম। সেই নির্বাচনে সদ্য ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। সহিংসতা হয়েছিল লক্ষণীয়ভাবে কম এবং নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রশংসিতও হয়েছিল। এই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণ দুটো: প্রথমত, যদিও উপজেলা পরিষদের হাতে ক্ষমতা সীমিত এবং স্থানীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের করণীয় কম, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে এই ক্ষমতার আরও সংকোচন ঘটেছে, তবু একার্থে এই পরিষদই হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের কাছে স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণের একধরনের প্রতীক। যেকোনো অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানের যে একটা প্রতীকী মূল্য আছে, তা অনস্বীকার্য। দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে মানুষের ভোটদানের বিবেচনায় জাতীয় রাজনীতি ছিল গৌণ।
কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী বাছাই করে দেওয়ার যে পদ্ধতি সংসদ নির্বাচনে ব্যবহূত হয়, তা থেকে উপজেলা নির্বাচন সম্পূর্ণ না হলেও মোটা দাগে মুক্ত ছিল। সেদিক থেকে রাজনীতিবিদেরা না চাইলেও উপজেলা পরিষদ তৃণমূল পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসিত একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সামান্য সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীরা উপজেলা নির্বাচনকে যেভাবে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলল, তাতে করে ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাতই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচনকে এতটা জড়িয়ে ফেলার কারণে এই নির্বাচন কার্যত দুই দলের, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের, জন্য মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়। প্রথম দুই দফা নির্বাচনে ভালো ফল না করার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে তৃতীয় দফা থেকেই যেনতেন প্রকারে নির্বাচনের চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কীভাবে বিজয় হলো, তার চেয়ে সংখ্যা এবং ফলাফল মুখ্য হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্বাচনের ধারা ও প্রকৃতিতে বদল ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় শেষ বা পঞ্চম দফায় এসে ভোট দেওয়ার দায়িত্ব থেকে ভোটারদের নিষ্কৃতি দিতে দ্বিধান্বিত হননি সরকারি দলের কর্মীরা। এতে করে বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর শেষ আস্থাও তিরোহিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের ভরসা রাখার জায়গা ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকেরা সম্ভবত আশা করেছিলেন যে ৫ জানুয়ারি ব্যতিক্রম হবে, যেমনটি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কেবল নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়।
কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যা অর্জিত হয়েছিল, তার মধ্যে টিকে ছিল নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাশাসনের আওতায় যেসব নির্বাচন হয়েছে সেগুলো যে সাজানো খেলার চেয়ে বেশি কিছু নয়, সে বিষয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেও, অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলেও এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের অনুকূল না হলেও অন্তত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের প্রতি একটি আস্থা তৈরি হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আস্থায় বড় ধরনের ফাটলের তৈরি হয়েছে। এখন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, বিশেষত শেষ দুই দফার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, দেশ আবার নব্বই-পূর্ববর্তী অবস্থায় গিয়েই দাঁড়াল বলে মনে হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে নাকচ করে দিতে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ বারবার বলেছে যে ২০০৮ সালের পর তাঁদের শাসনে সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনকে এক কাতারে বিবেচনা করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য ছিল যে ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে সরকারি দলের তাণ্ডব দেখতে পাইনি, পূর্বনির্ধারিত ফলাফল ঘোষণার চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারের এই দাবিকে ১৫ থেকে ৩১ মার্চের এই ১৬ দিনে ধূলিসাৎ করে দিয়ে ক্ষমতাহীন স্থানীয় পর্যায়ের একটি পরিষদের এই বিরাট বিজয় দিয়ে ক্ষমতাসীন দল কীভাবে লাভবান হবে, সেটা আমার কাছে বোধগম্য হয় না।
আগামীকাল: বিএনপি ও নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.