বিশেষ দূত হয়েও খুশি নন এরশাদ by রাজীব আহাম্মদ

জাপার চাহিদার শেষ নেই
প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা এবং সরকারে শরিকানা পেয়েও সন্তুষ্ট নন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলটির চাওয়া আরও অনেক বেশি। দলের চেয়ারম্যান এরশাদ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারা পর্যন্ত যে যার মতো তদবিরে ব্যস্ত। এ নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলেও বিভেদ ছড়িয়ে পড়েছে। এরশাদকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হলেও তার চাওয়া পদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক। অন্তত স্পিকারের সমমর্যাদা চান সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সরকারে আরও অংশীদারিত্ব চান। ডেপুটি স্পিকার এবং আরও তিনটি মন্ত্রিত্ব চান। দলটির কয়েক নেতা ডেপুটি স্পিকার পদ পেতে রওশনের কাছে তদবির করছেন। বিরোধী দলের উপনেতা ও চিফ হুইপ হতে তদবির চলছে বলে জানা গেছে। সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হতে এরশাদ এবং রওশন এরশাদ দু'জনের কাছেই তদবির করছেন দলের নারী নেত্রীরা। এরশাদের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকে। সে 'বঞ্চিতদের' কেউ কেউ 'ক্ষতিপূরণ' হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পদ চান। কেউ কেউ আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান হতে চান। ১২ জানুয়ারি এরশাদকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। জাতীয় পার্টির এরশাদপন্থি নেতারা জানান, মন্ত্রী পদমর্যাদার কারণে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত বোধ করছেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। সে কারণে গত চারদিন পদ পেলেও গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করছেন না। পদমর্যাদা-সংক্রান্ত বিধান 'ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স' অনুযায়ী সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদ রাষ্ট্রের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে পড়েন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির পরই তার অবস্থান। মন্ত্রীদের অবস্থান পাঁচ নম্বরে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকার পরও মন্ত্রী পদমর্যাদায় দূত করাকে অপমান হিসেবেই দেখছেন এরশাদ। সাবেক এ সামরিক শাসক অন্তত স্পিকারের পদমর্যাদায় মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত হতে আগ্রহী। স্পিকারের পদ সাংবিধানিক। নির্বাহী আদেশে এ মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো জানায়, পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এরশাদ সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দিতে পারেন। বিশেষ দূতের পদও ছাড়তে পারেন। তার দাবি মেনে নিতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও করছেন। বুধবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনও জানান।
সাম্প্রতিক সময়ে এরশাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ সমকালকে বলেন, 'হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে এমনিতেই মন্ত্রীর ওপরের পদমর্যাদায় রয়েছেন। সরকার তাকে মন্ত্রী পদমর্যাদা দেওয়ার নাম করে ডিমোশন দিয়েছে।'
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত করে সংসদে আনতে চান এরশাদ। লালমনিরহাট-৩ আসনে প্রার্থিতা বহাল থাকলেও এরশাদের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন জিএম কাদের। স্ত্রী রওশনের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ এরশাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ছোট ভাই জিএম কাদেরকে সংসদে চান এরশাদ। রংপুর-৬ আসন আওয়ামী লীগ ছাড় না দিলে পদত্যাগের হুমকি 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন এরশাদ। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি বানানোর সিদ্ধান্তেও এরশাদ অনড়। তবে দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে পুরনো বিরোধের কারণে শেরিফা কাদেরকে সংসদে আনতে রাজি নন রওশন।
ডেপুটি স্পিকার এবং আরও তিনটি মন্ত্রিত্ব চান রওশন। পানিসম্পদমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রকাশ্যেই এ চাওয়ার কথা জানান। এর জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনাও চলছে। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে বলেও জাতীয় পার্টির নেতারা জানান।
জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো জানায়, দলের মহাসচিব এবিএম রহুল আমীন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সালমা ইসলাম মন্ত্রিত্ব পেতে জোর তদবির করছেন। শেষের দু'জন রওশনের কাছে জোর তদবির চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত জিয়াউদ্দিন বাবলু প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের কাছে মন্ত্রিত্ব পেতে তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
রুহুল আমীন হাওলাদার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও সালমা ইসলাম মন্ত্রিত্ব পাওয়ার চেষ্টার কথা স্বীকার করেছেন। তাজুল ইসলাম সরাসরি অস্বীকার না করে বলেন, 'নিজ নিজ অবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা সবাই করে। এটা দোষনীয় নয়।' রুহুল আমীন হাওলাদার এরশাদের মারফতে তদবির চালাচ্ছেন বলে এরশাদপন্থিরা জানান। প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মনোভাব থাকায় রুহুল আমীন হাওলাদার ও সালমা ইসলামের পক্ষে মন্ত্রিত্ব পাওয়া কঠিন বলেই সূত্র মনে করছে।
বিরোধী দলের উপনেতা প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার। বিরোধী দলের নেতার ডান পাশের আসনে বসার সুযোগ পান উপনেতা। জাতীয় পার্টির এমপিদের অনেকেই উপনেতা হওয়ার তদবিরে আছেন। কাজী ফিরোজ রশিদ, তাজুল ইসলাম, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, জিয়াউল হক মৃধা এ পদের দাবিদার। ফিরোজ রশিদ সাবেক মন্ত্রী ছিলেন। তবু প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার বিরোধীদলীয় উপনেতা হতে আগ্রহী। তাজুল ইসলাম মন্ত্রিত্ব না পেলে কমপক্ষে উপনেতার পদ চান। ফিরোজ রশিদ স্বীকার না করলেও রওশনপন্থি নেতারা জানান, মন্ত্রিত্ব না পেয়ে উপনেতা হওয়ার দৌড়ে নেমেছেন তিনি।
বিরোধী দলের চিফ হুইপের সরকারি কোনো মর্যাদা নেই। তবে সামাজিক মর্যাদা ও গণমাধ্যমের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ পদে রুহুল আমীন হাওলাদারের নাম শোনা গেলেও তিনি আগ্রহী নন। জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম সমকালকে বলেন, আগ্রহী অনেকেই আছেন। সবাই নিজের মতো করে চেষ্টা করছেন। সময় হলেই দেখতে পারবেন। পীর ফজলুর রহমান, নাসিম ওসমান, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদ পেতে। রওশনের কাছে নিয়মিত তদবির করে চলেছেন তারা।
মহিলা এমপি হতেও তদবির কম নয়। এ নিয়ে আবার বিরোধও আছে। খোদ এরশাদ ও রওশন এরশাদ বিরোধে জড়িয়েছেন মহিলা এমপি পদ নিয়ে। ৩৩ আসন পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী জাতীয় পার্টি ৬টি মহিলা আসন পেতে পারে। শেরিফা কাদের, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, পালক কন্যা মৌসুমী আক্তার, জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদিকা নাজমা আক্তার এবং মেহজাবিন মোরশেদকে এমপি বানাতে চান এরশাদ। প্রথম তিনজনের কেউই রওশনের পছন্দের নয়। রওশন তাদের এমপি বানাতে রাজি নন। মহিলা পার্টির সভানেত্রী নূরে হাসনা চৌধুরী লিলি, আনোয়ারা বেগম, দলের যুগ্ম মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার স্ত্রীসহ আরও কয়েক নেত্রী এমপি হতে রওশনের কাছে তদবির করছেন।

No comments

Powered by Blogger.