সমঝোতার শেষ সুযোগ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে অনেকটা দশম সংসদ নির্বাচনের গুরুত্বহীনতা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিলম্বে হলেও এটা তিনি ও তাঁর দল বুঝতে পেরেছে। তবে আমরা মনে করি, এখনো সময় আছে, একাদশ নয়, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়েই সমঝোতা করা যায়। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। দুই বড় দল একমত হলে তফসিল পরিবর্তন কর সমস্যা নয়। দশম সংসদ নির্বাচন যদি এভাবে পরিহাসের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় ও সরকার গঠিত হয়, তাহলে আশঙ্কা করি দেশ, জনগণ, অর্থনীতি এবং আওয়ামী লীগেরই আরও বেশি ক্ষতি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই বোধোদয়কে পাথেয় করে দুই বড় দলের মধ্যে যত রকম ছাড় দেওয়া সম্ভব, তা দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথাই এখন ভাবা উচিত। সংবিধান, তফসিল, ব্যক্তিগত জেদ ইত্যাদি কোনো কিছুই দেশের চেয়ে বড় নয়। দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিলে সমঝোতা এখনো সম্ভব। যাঁরা ভাবছেন, ‘এই নির্বাচন হয়ে যাক, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা করব’, তাঁরা হয়তো কল্পনাও করতে পারছেন না, তা কত দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে।
প্রহসনের নির্বাচন সম্পর্কে বিদেশি শক্তিসমূহ ও জাতিসংঘের মনোভাবও অনুকূল নয়। ব্যতিক্রম ভারত। শুধু ভারতের সমর্থন দিয়ে সরকার কি চলতে পারবে? এখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করে নতুন তফসিল দিয়ে, সব প্রধান দলের অংশগ্রহণে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এটাই সময়ের দাবি। নইলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি, প্রধান দলগুলো, তাদের নেতারা বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে, তারা কি ব্যক্তির জেদকে বড় করে দেখবে, নাকি দেশ ও দলের সামগ্রিক ভবিষ্যৎকে? আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ এ রকম ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চাইছে যে শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন, তাহলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ হেরে যাবে। আর বিএনপি এ ঘটনাকে তাদের ‘বিজয়’ দাবি করে দেশব্যাপী বিজয় উৎসব পালন করবে। এই মহল এমনও ধারণা দিচ্ছে যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা, সমর্থক বুদ্ধিজীবীসহ অনেকে আক্রমণের শিকার হবেন। তাঁদের অনেককে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। ইত্যাদি। এই আশঙ্কার ভিত্তি আছে বলে মনে করি না। একতরফা নির্বাচন করলে ছয় মাস বা এক বছর পরে আওয়ামী লীগকে যখন আবার নির্বাচন দিতে হবে, তখন আওয়ামী লীগের কী দুরবস্থা হতে পারে, তা এই শুভানুধ্যায়ীরা বলেন না।
তাঁরা শুধু শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ না করার ভুল পরামর্শ দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে বিএনপি দেশে বিরাট লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে—এমন আশঙ্কা যাঁরা করছেন, তাঁদের কথা ভেবে কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। ১. দুই পক্ষের যে সমঝোতা চুক্তি হবে তাতে এমন শর্তও থাকতে পারে, নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল মিছিল করতে পারবে না। ২. ১৪ দল বা ১৮-দলীয় জোটের কোনো নেতা বা সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগে কোনো মামলা দিতে পারবে না। ৩. নির্বাচনের আগে আগের কোনো মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে পারবে না। ৪. সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দেওয়া হবে। সাম্প্রতিক সহিংসতা দমন করতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের নৈতিক জোর না থাকলে জনগণের আন্দোলন দমন করা সম্ভব হয় না। সরকার বিএনপির সব নেতাকে মুক্তি দিয়ে বিএনপি তথা ১৮-দলীয় জোটকে স্বাভাবিক পথে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার (সভা, মিছিল, বিক্ষোভ, হরতাল ইত্যাদি) সুযোগ দিক। আর যারা সহিংসতা করছে, মানুষ মারছে, তাদের কঠোর হাতে দমন করুক।
সন্ত্রাসীদের ধরতে বা শাস্তি দিতে বিএনপি কোনো বাধা নয়। দেখতে হবে, সন্ত্রাসী ধরার নামে যেন বিরোধী দলের নিরীহ নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার না হয়। বিএনপি বা ১৮-দলীয় জোটকে গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে না দিলে চোরাপথে সন্ত্রাস হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিএনপি দাবি করেছে, তারা এই সহিংসতা করেনি। কিন্তু তা তারা কাজে, কথায় ও ভূমিকা দিয়ে প্রমাণ করতে পারেনি। এই সহিংসতা ‘সরকার’ করছে, তাও বিএনপি প্রমাণ করতে পারেনি। এই সহিংসতা যদি জামায়াতও করে থাকে, বিএনপি তার যথেষ্ট নিন্দাও করেনি। বিএনপি এই সহিংসতা করুক বা না করুক, সাধারণ মানুষের ধারণা, তা বিএনপি-জামায়াতই করছে। কাজেই সাম্প্রতিক এই সহিংস ঘটনাবলির যদি কোনো মাইনাস পয়েন্ট থাকে, তাহলে তা বিএনপিই পাবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ ত্যাগ করলে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়বে বলেই আমরা ধারণা করি। নানা কারণে গত কয়েক বছরে দেশে-বিদেশে তাঁর কিছু নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। একটি নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে পারবেন।
১. বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন, অবরোধ ও হরতাল থামিয়ে দিতে পারবেন। ২. বিএনপি, ১৮-দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে পারবেন। ৩. দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন। ৪. তিনি দল বা ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশকে যে ওপরে স্থান দেন, তা প্রমাণ করতে পারবেন। আওয়ামী লীগ বারবার সংবিধানের যে দোহাই দিচ্ছে, তা ঠুনকো যুক্তি। সংবিধান সংশোধন এক মিনিটের কাজ। দেশ, দেশের মানুষ, দেশের অর্থনীতি ও গণতন্ত্রচর্চার চেয়ে সংবিধানের একটি ধারা বড় হতে পারে না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা যত দ্রুত এটা উপলব্ধি করবেন, ততই দেশের মঙ্গল। তা না করে জেদপূর্বক ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন করলে দেশকে বিরাট অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। এখনো সময় আছে। দয়া করে সমঝোতা করুন। এই নিবন্ধ লেখার সময় আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পেছানো ও সমঝোতার আর সম্ভাবনা নেই, তাদের মতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও জটিলতার কথা যেন তারা ভাবে।
আরও একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। যে বড় দল দুটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ, তারা কী জাদুমন্ত্রে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাবে? সেই জাদুমন্ত্রটি কী? দুই দল তাদের প্রধান দুটি শর্ত (প্রধানমন্ত্রী পদে কে থাকবেন) ছেড়ে দেবে? এ কথা বাংলাদেশের কেউ বিশ্বাস করেন? তাহলে কী আশায় আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা ভাবছেন, পরের নির্বাচনে সমঝোতা হবে। একটা মাত্র পথ খোলা আছে, সমঝোতার। আওয়ামী লীগে অনেক ঝানু, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সাবেক কূটনীতিক রয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ভাবনাচিন্তা তাঁরা আমাদের চেয়ে ভালো বুঝবেন আশা করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.