খালেদার বক্তব্য ইতিবাচক by বদিউল আলম মজুমদার

বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলে মনে করি। বিশেষ করে তিনি হরতাল, অবরোধের কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কেননা হরতাল-অবরোধ সরকারের যা ক্ষতি না করে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে সাধারণ মানুষের। তাদের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতির গতি হয়ে পড়ে স্থবির।
সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধে নাশকতা ও সহিংসতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। এখনো অনেকে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। এ কারণে বিরোধী দলের নেতার ঘোষিত ২৯ ডিসেম্বরের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি যদি শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে কারও আপত্তি থাকবে না। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে সহায়তা করা। বাধা না দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, রাজপথে এ ধরনের বড় কর্মসূচি দুই শক্তিকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করায়। এক পক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে, অন্য পক্ষ বিরোধীদের প্রতিহত করতে চাইবে। ফলে বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং সহিংসতার ঝুঁকি থেকেই যায়। এ কারণে আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। রাজপথে আন্দোলনে সাময়িক বিজয় লাভ করা যেতে পারে কিন্তু সংকটের সমাধান হবে না। বরং দেশকে আরও গভীর সংকটে ফেলতে পারে। অতএব, বিরোধী দল যেহেতু হরতাল অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসেছে, সরকারেরও উচিত হবে তাদের প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখানো। কারাগারে আটক বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দিয়ে এবং বিরোধী দলের অফিসের সামনের অবরোধ তুলে দিয়ে সরকার আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। যত দ্রুত আলোচনা হবে ততইদেশের জন্য মঙ্গল। ইতিমধ্যে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এই ক্ষতি বাড়তে দেওয়া যাবে না। আশা করি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সত্য উপলব্ধি করবেন। সরকার ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের যে আয়োজন করেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ইতিমধ্যে ৫৩ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ১৫৪টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যান্য আসনে কতসংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে যাবেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। তাই আমরা মনে করি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে সমঝোতার পথ প্রশস্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন অনেক আগেই বলেছিল, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এটি করা তাদের জন্য কঠিন হবে না। জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা হলে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার যে সুযোগ আছে, তারা তা গ্রহণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। যেনতেন একটি নির্বাচন কিংবা নির্বাচন প্রতিহত করার নামে রাজপথে জনগণকে জিম্মি করার রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুই দশকেরও বেশি পালা করে দেশ চালিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের প্রতিই সবাই তাকিয়ে আছেন। দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে দুই নেত্রী যদি টেকসই উদ্যোগ নেন, তাহলে ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিরোধীদলীয় নেতা সংবাদ সম্মেলনে আরও অনেক কথাই বলেছেন।
সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি। আর সেই সমাধানের উপযুক্ত মাধ্যম হলো আলোচনা। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সমঝোতা হওয়া মানে পরাজিত হওয়া নয়। আমরা আশা করব, তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকৌশলেই সেই সমঝোতাকে অগ্রাধিকার দেবেন। বিরোধী দলের নেতা সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধে সংঘটিত সহিংসতার দায় সরকারের ওপর চাপিয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন শান্তি। তাই, কারও এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে শান্তি বিঘ্নিত হয়। খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে হবে, জামায়াতের এজেন্ডা আলাদা। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া তাদের লক্ষ্য নয়। তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত ব্যক্তিদের বাঁচাতেই আন্দোলনের নামে সারা দেশে সহিংসতা চালাচ্ছে। বিএনপির মতো একটি গণতান্ত্রিক দল কেন তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। তবে খালেদা জিয়া জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির বিষয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলে মনে করি। তবে একই সঙ্গে জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দাও প্রত্যাশিত ছিল।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.