তবু বিএনপি নির্বাচনে আসুক

বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধ কয়েকজন। রাজনীতির
নামে এই সহিংসতা আর কত দিন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাল্ফ ডরেনডর্ফ লিখেছেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের কণ্ঠস্বর; যারা প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব। আমাদের সংবিধানেও জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক বলে উল্লিখিত। ডরেনডর্ফ গণতন্ত্রের তিনটি পূর্বশর্তের কথা বলেছেন: এক. সহিংসতা ছাড়া সমাজে পরিবর্তন আনা, দুই. এটি হলো এমন এক ব্যবস্থা, যার দ্বারা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, ক্ষমতাসীনেরা যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে, তাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা এবং ক্ষমতা প্রয়োগে সব নাগরিকের ভূমিকা নিশ্চিত করা। ক্ষমতা প্রয়োগে সব নাগরিকের ভূমিকা নিশ্চিত করার উপায় হলো নির্বাচন। নির্বাচন মানে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন বাছাই প্রক্রিয়া। শাসনতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে আমরা অনেক আগেই বিদায় দিয়েছি। এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্রকেও নির্বাসনে পাঠানোর আয়োজন চলছে। এ দায় কে নেবে—সরকার, বিরোধী দল, নাকি উভয়েই? গণতন্ত্রের লক্ষ্য যদি হয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ কর্মসম্পর্ক, গণতন্ত্রের লক্ষ্য যদি হয় জাতীয় সংসদকে সচল ও সজীব রাখা, গণতন্ত্রের লক্ষ্য যদি হয় সব সন্দেহ ও অবিশ্বাস পেছনে ফেলে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, গণতন্ত্রের লক্ষ্য যদি হয় রাষ্ট্রের মূল তিন স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভাকে পৃথক সত্তা স্বীকার করে নেওয়া এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, তাহলে বলতে হবে, আমাদের দেশে সেই গণতন্ত্র কখনোই ছিল না, এখনো নেই, অদূর ভবিষ্যতে হবে কি না বলা কঠিন।
দুই গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। গত ৪২ বছরেও আমরা সেই ব্যবস্থা করতে পারিনি। প্রতিবারই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে একটি রক্তাক্ত অধ্যায় তথা প্রচুর প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এসব রক্তাক্ত অধ্যায় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা অতীত থেকে শিক্ষা নেন না। বরং পরবর্তী রক্তাক্ত অধ্যায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। অন্যদিকে বিরোধী দলও নির্বাচনের পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারে না। মনে করে, তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ও ২০০৮ সালে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি লক্ষ করুন। আসলে নিজেকে ক্ষমতার বাইরে দেখতে না পারার মানসিকতাই আমাদের গণতন্ত্রের বড় দুর্বলতা। যাঁরা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে মনের মতো সাজিয়েছিলেন, আর যাঁরা আদালতের দোহাই দিয়ে বাতিল করেছেন, তাঁদের উভয়ের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ক্ষমতার বাইরে থাকা যাবে না। বিএনপি সেই কূটকৌশলে জয়ী হতে পারেনি, তবে আওয়ামী লীগ পারবে কি? বর্তমানে দেশে নির্বাচন বা আন্দোলনের নামে যা চলছে, তা কোনোভাবেই সুস্থ রাজনীতি নয়। ক্ষমতাসীন দল ও জোট বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন করে ফেলতে চায়। তাদের ভয়, বিরোধী দলের দাবি মানলে পরাজয় অনিবার্য। আর বিরোধী দল মনে করে, যেহেতু বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়া যাবে না, তাই সেই নির্বাচন ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এবং করছেও। তারা হরতাল-অবরোধ করে দেশ অচল করে দিতে চাইছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থাকলে তাতে আপত্তির কিছু ছিল না।
কিন্তু হরতাল-অবরোধের নামে যখন আগুনে গাড়ি পুড়িয়ে, ভাঙচুর করে, রেলওয়ের ফিশপ্লেট খুলে এবং স্লিপার উপড়ে মানুষ হত্যা করা হয়, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়, তখন আর সেটি রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে না। হয়ে পড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আবার বিরোধী দলের কথিত নৈরাজ্য বন্ধে সরকার যে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, গয়রহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠাচ্ছে, রিমান্ডে নিচ্ছে, তা-ও গণতান্ত্রিক শাসনের পরিপন্থী। বিজয়ের জন্য শয়তানের সঙ্গে সখ্য করতেও এই দুই দলের বাধে না। সরকারি দলের সঙ্গে এরশাদের এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের গাঁটছড়া বাঁধাই এর বড় প্রমাণ। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ বিচলিত ও বিপন্ন বোধ করছে। উদ্বিগ্ন বিশ্ব সম্প্রদায়ও। জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হয়ে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসছেন। ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাইদা ওয়ারসি আসছেন ১২ ডিসেম্বর। তাঁরা আগেও এসেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তাঁদের সবার উদ্বেগ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। সর্বনাশের গিরিখাতে দাঁড়িয়েও তাঁরা যুদ্ধের হুংকার ছুড়ছেন।
তিন পত্রিকান্তরের খবরে জানা যায়, বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে এক. শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। তাঁর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার বা কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির কাছে দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দিতে হবে। দুই. বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভেঙে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তিন. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। চার. বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে আসতে দিতে হবে এবং নেতা-কর্মীদের মামলা প্রত্যাহারসহ মুক্তি দিতে হবে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বিএনপি এসব দাবির কথা বললেও তাদের মূল দাবি শেখ হাসিনার বদলে অন্য কাউকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা। সর্বশেষ তারা শেখ হাসিনাকেও নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানতে রাজি আছেন, যদি তাঁর একক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন সে রকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ছয় বিশিষ্ট নাগরিকও আপস রফা হিসেবেও একই কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলটির কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তারা বলছে, বিএনপি নীতিগতভাবে সংবিধানের আওতায় সমাধানের ব্যাপারে রাজি হলে অন্যান্য বিষয় আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা যাবে। বিরোধী দল বাইরে গরম দেখালেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তারা মুখ রক্ষার জন্য একটা কিছু চাইছে। কিন্তু সরকারি দল মনে হচ্ছে, তাতেও রাজি নয়। বিরোধী দল নির্বাচনে না এলেই তারা বরং খুশি।
নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিযোগী সরকারি দল ও বিরোধী দল। আর রেফারির ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন।এখন দুই প্রতিযোগীর একজন অনুপস্থিত থাকলে সেটি খেলা হবে না এবং রেফারিরও প্রয়োজন পড়বে না। নির্বাচন মানেই সবাইকে নিয়ে নির্বাচন। নির্বাচন মানেই বাছাইয়ের সমান সুযোগ। নির্বাচন মানেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। এখন সেই কাজটি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মীরাও দাবি করে আসছেন, ক্ষমতাসীন দল ও জোট বিএনপিকে বাইরে রেখেই একতরফা নির্বাচন করার চক্রান্ত আঁটছে। তাহলে বিএনপির করণীয় কী? অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বিএনপি যে পদ্ধতিতে আন্দোলন করছে, তাতে জনসম্পৃক্ততাও বাড়বে না। মানুষ ভয়ে ঘরে বন্দী থাকছেন, বাস-গাড়ি রাস্তায় বের হচ্ছে না। আবার বিরোধী দলের আহ্বানে তাঁরা রাস্তায় নেমেও আসছেন না। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে মানুষের সব আগ্রহ-মনোযোগও নির্বাচনের দিকে যাবে। বাংলাদেশে যেমন নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস আছে, তেমনি বড় দল ছাড়া নির্বাচন করার ইতিহাসও আছে। এক-এগারোর পট পরিবর্তন না এলে কি বিএনপি নিজে থেকে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করত? অবশ্যই নয়।
চার বিভিন্ন জরিপ বলছে, এবারের নির্বাচনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা আছে। সে ক্ষেত্রে তারা কেন নির্বাচন বর্জন করবে? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও তারা পাঁচটি সিটি নির্বাচনে জিতেছে। জিতেছে চট্টগ্রামে, কুমিল্লায় ও হবিগঞ্জ উপনির্বাচনে। জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে উপনির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচনের পার্থক্য আছে। কিন্তু তাই বলে এখন রাতকে দিন করা যাবে না। ভোটের বাক্স উল্টানোরও সুযোগ নেই। এখন গণমাধ্যম স্বাধীন। টিভি ক্যামেরা প্রতিটি কেন্দ্রে পাহারা দেবে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা থাকবেন। এত সব সত্ত্বেও যদি সত্যি সত্যি কোনো দল জনরায় উল্টে দিতে চায়, মানুষ তখন রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ করবে। তখন জনগণকে নিয়েই বিএনপি আন্দোলন করতে পারবে। অতএব শত শত প্রতিবন্ধকতা ও বৈরিতা সত্ত্বেও বিএনপির উচিত আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজের শক্তি পরীক্ষা করা। নির্বাচনী হাওয়া তার পক্ষেই আছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতিকূল পরিবেশেই বিরোধী দল বরাবর জয়ী হয়েছে। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে যুক্তফ্রন্ট জিতেছে, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
১৯৯১ সালেও বিএনপি অনেকটা প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচন করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাই, বর্জনের ঝুঁকিপূর্ণ পথ ছেড়ে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ না দিয়েও বিএনপি প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে পারে। তবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার অনুকূল পরিবেশ তৈরির কাজটি ইসিকে করতে হবে। তফসিল পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বিরোধী দল প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে। বিরোধী দলের আটক নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দিতে হবে। মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। যথাসম্ভব প্রশাসনের একটি নিরপেক্ষ চেহারা দিতে হবে, যাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা আশ্বস্ত হতে পারেন। জমি পুরোপুরি সমতল না হলেও অসমতলের মাত্রাটি কমবে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে, কখনো বিরোধী দলের বোমার ঘায়ে, কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। এঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ, রাজনীতি না-করা মানুষ। তবু তাঁরা সন্ত্রাসের শিকার। এই অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়। আর তার একমাত্র উপায় হলো সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। সরকার চাইছে না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। তাদের এই না চাওয়ার মোক্ষম জবাব হতে পারে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া। জয়ের যে সম্ভাবনা তাদের হাতছানি দিচ্ছে তা হেলায় হারানো ঠিক হবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.