রফিকুল এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর সেই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। কানাডাপ্রবাসী দুজন বাংলাদেশি নাগরিকের তিনি ছিলেন অন্যতম, যিনি ১৯৯৮ সালে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে লবিং করেছিলেন। এই মিশনে তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুস সালাম। তাঁরা ছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রচলনের উদ্যোগী। শুধু বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়েই তাঁদের সাফল্য সীমিত ছিল না। এটি করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্য নানা ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং শ্রদ্ধা করার অঙ্গীকারও করা হয়েছে এই ঘোষণায়। সেই দিক থেকে তাঁদের অবদান শুধু দেশের জন্য সীমিত নয়। দলের সংকীর্ণ পরিচয়ের বাইরে থেকে একটি বড় কাজ করার চিন্তা, উদ্যোগ এবং সেই কাজে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের সহযোগিতা পাওয়া এক বিরল ঘটনা। দলের লোক না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্দল লোকের অতি ছোট আইডিয়াও সরকারের আনুকূল্য লাভ করে না। তাঁদের এই উদ্যোগ ও সাফল্য বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের পাশাপাশি এই দুজন বিশিষ্টজনের অবদানও স্মরণীয়। রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম মাতৃভাষা বাংলা ও মাতৃভূমির জন্য তাঁরা তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী করেছেন। কিন্তু তার ফলোআপ হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি? আমাদের কোনো সরকার কি সেই দায়িত্ব পালন করেছে? আমরা হচ্ছি অনুষ্ঠানপ্রিয় জাতি, বক্তৃতাপ্রিয় জাতি। রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও বক্তৃতা করার কোনো সুযোগ ছাড়িনি। তাঁদের জন্য বিষয়টার এখানেই হয়তো সমাপ্তি। কিন্তু কাজটা তো আরও অনেক বড় ছিল। ২০০০ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর শহীদ দিবস সংখ্যায় এই বিষয়ে সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনার একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এটা কারও নজরে এসেছিল কি না, জানি না। নজরে এলেও কিছু হতো কি না, আমার সন্দেহ। কারণ, বাংলাদেশে কী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়, কে প্রস্তাব দিয়েছে। এটাই আমাদের দূষিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। সেদিন কী প্রস্তাব দিয়েছিলাম, একালের পাঠকের জন্য তার সারকথা আবার তুলে ধরছি। জাতিসংঘ প্রস্তাব পাস করেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।
জাতিসংঘের এ রকম অসংখ্য ‘দিবস’ রয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান দিবসের পেছনে না থাকলে তা জাতিসংঘের নথিতেই পড়ে থাকত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হবে ইউনেসকো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস ইউনেসকোতে অব্যাহত লবিং করে এ ব্যাপারে ইউনেসকোকে সক্রিয় করতে হবে। ইউনেসকোর চিঠি ও অনুরোধে অন্যান্য দেশকেও সক্রিয় করা যায়। বাংলাদেশের দায়িত্ব হবে ইউনেসকোকে এই বিষয়ক লেখা, ছবি, ভিডিও ও পোস্টার ডিজাইন দিয়ে সহায়তা করা। ইউনেসকোর মাধ্যমে প্রত্যেক দেশের সরকারকে অনুরোধ করা যায়, তাদের দেশের স্কুল পাঠ্যবইতে বা সহ-পাঠ্যবইতে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রচনাকে স্থান দিতে। যে রচনায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোথায় কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, মাতৃভাষার গুরুত্ব কী, মাতৃভাষা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কেন ইত্যাদি বক্তব্য থাকবে। যাতে পৃথিবীর নানা দেশের একজন স্কুলছাত্র জীবনের প্রারম্ভেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অনুভব করতে পারে। আমরা অনেকেই আমেরিকাকে চেনার আগেই স্কুল পাঠ্যবই পড়ে ১ মে শিকাগো নগরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল তা জানতে পেরেছিলাম। এভাবে বাংলাদেশকে না চিনেও পৃথিবীর নানা দেশের স্কুলছাত্ররা স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে ‘ঢাকা’ ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে জানতে পারবে। ইউনেসকোকে দিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
সার্ক দেশগুলোতে আমরা নিজেরা এই চেষ্টা চালাতে পারি। এটা নিছক বাংলাদেশের প্রস্তাব নয়। এটা জাতিসংঘ-স্বীকৃত একটি দিবস। কাজেই বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করা অনেক সহজ হতো। সার্কের পর আশিয়ান দেশগুলোয় বাংলাদেশ চেষ্টা চালাতে পারত। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ও পোশাকশিল্প ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর কিছুই ইতিবাচকভাবে পরিচিত নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একটি ইতিবাচক পরিচিতি হতে পারত। ক্ষুদ্রঋণ বা পোশাকশিল্প দুটোই প্রাইভেট সেক্টরের, এতে সরকারের ভূমিকা খুব সামান্য। এখন তৃতীয় যে ইস্যুটা আমরা পেয়েছি, তার প্রচারে সরকার একটা বড় প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। এই অর্জনটাও পুরোপুরি সরকারের নয়। তবু সরকার এই অর্জনে ভাগ বসাতে পারে। কারণ, সরকার এই কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তবে সরকার প্রকৃত কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে যদি বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারিকে পরিচিত করতে পারে। শুধু বক্তৃতা দিয়ে বা ফিতা কেটে এটা সম্ভব হবে না। এর জন্য দরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা, দক্ষ লোকদের টিম, বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ, মনিটরিং ইত্যাদি। ২০১৪ সালে এই কাজ শুরু করলে ২৫ বছরের মধ্যে একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ফল পাওয়া যেতে পারে।
যদি সরকার এ ব্যাপারে কাজ করতে আগ্রহী হয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ জন্য একটা সেল তৈরি করতে হবে। যেটা তাদের সার্বক্ষণিক কাজ হবে। তার আগে দরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত। সরকার একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট করেছে। গত কয়েক বছরে তাদের অবদান কী, তা-ও দেশবাসীর অজানা। এই ইনস্টিটিউট গঠন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই ইনস্টিটিউটের কাজ বাংলা একাডেমির একটি নতুন বিভাগও করতে পারত। মনে হয় সরকারের টাকার অভাব নেই। তা দেখে ভরসা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সেল গঠন করা অসম্ভব কোনো কাজ হবে না। আমাদের প্রস্তাবটি সরকার ভেবে দেখতে পারে। এভাবেই আমরা মাতৃভাষা বাংলা, একুশের শহীদ ও প্রয়াত রফিকুল ইসলামের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে পারব। প্রয়াত রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযাত্রী আবদুস সালাম তাঁদের কাজ করেছেন। আসুন, আমরা এবার আমাদের দায়িত্ব পালন করি। সম্প্রতি বাংলা একাডেমিতে ‘হে উৎসব’ নামে বিদেশি সাহিত্যের একটা আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে গেল। এর উদ্যোক্তা দ্য ডেইলি স্টার ও কয়েকটি সংস্থা। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য এ ধরনের উৎসবের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় সৃজনশীল লেখার লেখকের সংখ্যা খুবই কম। আজ কম বলে ভবিষ্যতে কম থাকবে, এমন মনে করার কারণ নেই। হে উৎসব ও ইংরেজি দৈনিকের সাহিত্য পাতা ইংরেজি ভাষায় সৃজনশীল লেখকদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। এ রকম চর্চা চলতে থাকলে একদিন বাংলাদেশের লেখকদের ইংরেজি ভাষায় রচিত সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম বা বই এশিয়ায় ও অন্যান্য মহাদেশের পাঠকদের কাছে সমাদৃত হতে পারে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের মাতৃভাষার সৃজনশীল সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের মান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে আমাদের পরিচিতি নেই বললেই চলে। এর প্রধান কারণ আমাদের উন্নত মানের সাহিত্য ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় তেমন অনূদিত হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও এ নিয়ে কোনো সরকার কোনো পরিকল্পনাও গ্রহণ করেনি। আমাদের প্রস্তাব: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে সাহিত্য ও উচ্চতর পাঠ্যবইয়ের অনুবাদকর্মের জন্য ঢেলে সাজানো হোক। বাংলাদেশের নির্বাচিত সৃজনশীল সাহিত্য প্রতিবছর ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদের কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক। অনূদিত বই বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এভাবে কাজটা শুরু হোক। ক্রমে তা বড় একটি অনুবাদ প্রকল্পে পরিণত হতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments