বাংলাদেশ কী পাবে?
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অতীতে বিভিন্ন সময়ে যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সম্মেলন ঘিরে আগ্রহ, উৎসাহ ও উত্তেজনা কোনোটিই কম ছিল না। সিয়াটল (১৯৯৯), দোহা (২০০১), কানকুন (২০০৩) বা হংকং (২০০৫) সম্মেলনের কথা স্মরণ করলেই তা বোঝা যায়। আর তাই আগামী ৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নবম সম্মেলন ঘিরে আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, বালি সম্মেলন কি তেমন উত্তেজনাকর হবে? বাংলাদেশই বা এই সম্মেলন থেকে কী পাবে? ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুসারে দুই বছর পর পর সদস্যদেশগুলোর বাণিজ্যমন্ত্রীরা একটি সম্মেলনে মিলিত হয়ে থাকেন। এতে বিশ্ব বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। তবে ২০০১ সালে দোহা পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকে এই সম্মেলন নতুন মাত্রা পায়। যেমন, ২০০৫ সালের সম্মেলনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ এলডিসির জন্য বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে। বালিতে এলডিসির প্রথম বিষয়টি হলো কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা। ডব্লিউটিওর গোড়াপত্তন থেকেই এলডিসিগুলোর প্রধান দাবি হলো, এই বাজারসুবিধা যা থেকে বাংলাদেশও বড় আকারে উপকৃত হতে পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নত দেশ এলডিসিগুলোকে অবাধ বাজারসুবিধা দিয়েছে। যেমন, ২০০১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর ২০০২ সালে কানাডা। ডব্লিউটিওর হংকং সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল উন্নত দেশগুলো তাদের ট্যারিফ লাইনের অন্তত ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে এলডিসিগুলোকে অবাধ বাজারসুবিধা দেবে।
বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব উন্নত দেশই এলডিসিগুলোকে প্রায় পূর্ণ বাজারসুবিধা দিয়ে দিয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ২০০৫ সালের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা সামর্থ্যবান, তারাও যেন এই সুবিধা দেয়, সে সিদ্ধান্তও ছিল; যদিও অনেক দেশই তা সীমিত পরিসরে দিয়েছে। সম্প্রতি জেনেভায় এই বাজারসুবিধার বিষয়ে এলডিসিগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়া আফ্রিকার কয়েকটি দেশ অভিযোগ করেছে, এশিয়ার এলডিসিগুলোকে যদি একই রকম বাজারসুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যখন বলা হলো, পণ্য পার্থক্যের কারণে আমাদের (বাংলাদেশ) সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর তেমন কোনো প্রতিযোগিতা নেই, তখন পাল্টা যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে তাদের নতুন ও সম্ভাবনাময় পণ্য এই প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। তবে এই যুক্তি সঠিক নয়। বালি সম্মেলন থেকে আমরা সর্বোচ্চ এটুকুই আশা করতে পারি, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের দেওয়া বাজারসুবিধার পরিধি বাড়ানো এবং তা ডব্লিউটিওর তদারকির মধ্যে আনার বিষয়ে সমঝোতা। এটা অবশ্য প্রতিশ্রুতির অংশ হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রথমবারের মতো আমরা বহুপক্ষীয় সম্মতির একটি উৎসবিধি (রুলস অব অরিজিন) পেতে পারি। এটা তিনটি পদ্ধতিতে হতে পারে: মূল্যানুপাতিক শতকরা হিসাব; এইচএস শ্রেণীকরণে পরিবর্তন; এবং সুনির্দিষ্ট উৎপাদন বা প্রক্রিয়া পরিচালন। স্বচ্ছতা ও দালিলিক প্রয়োজনীয়তার সংস্থানও থাকছে, যা একটি ইতিবাচক দিক।
আমাদের রপ্তানিকারকদের এ বিষয়গুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। তৃতীয়ত, সেবা খাতে এলডিসিগুলোর সুবিধার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে হয়েছে। আগামী বছরের জুলাই মাসে সদস্যদেশগুলো একটি সম্মেলন করে জানান দেবে যে এলডিসিগুলোর জন্য কোন কোন খাত এবং কোন ধরনের সেবা সরবরাহে অগ্রাধিকার-সুবিধা দেওয়া হবে। বালিতে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হলে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির জন্য সহায়ক হবে। বাজারসুবিধার বাইরে বাণিজ্য সহজীকরণও এলডিসিগুলোর জন্য বালি সম্মেলনে তাৎপর্যপূর্ণ হবে। গ্যাট চুক্তির তিনটি অনুচ্ছেদ পরিবর্তন এখনো সমঝোতার অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো হলো: পঞ্চম অনুচ্ছেদ—ট্রানজিটের স্বাধীনতা; সপ্তম অনুচ্ছেদ—আমদানি ও রপ্তানির মাশুল ও আনুষ্ঠানিকতা; এবং দশম অনুচ্ছেদ—বাণিজ্য প্রবিধানের প্রকাশনা ও প্রশাসন। সদস্যদেশগুলো একটা চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে এই তিনটি বিষয়ই একত্রে গাঁথা। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে ট্রানজিটের স্বাধীনতার বিষয়টি। বিস্তারিত কার্যপদ্ধতি মোটামুটি সমঝোতা হয়ে গেছে। ট্রানজিট দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর এ বিষয়গুলো প্রভাব ফেলবে। আমাদের এ জন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে। নতুন কাস্টমস-প্রক্রিয়া ও আনুষ্ঠানিকতাও তা প্রভাব ফেলবে।
যদিও এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কিছুটা ছাড় আছে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিন ধরনের সময়সীমা রাখা হয়েছে: তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন, নির্ধারিত বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন এবং উন্নত দেশগুলো থেকে কারিগরি ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা পাওয়া সাপেক্ষে বাস্তবায়ন। তবে এখন পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো থেকে তাদের নিয়মিত সহায়তার বাইরে বাড়তি কোনো সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। আমাদের শুল্ক কর্তৃপক্ষের এই সমঝোতায় নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকা প্রয়োজন। বালি সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার কাজ চলছে। তিনটি ক্ষেত্র বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে: বাণিজ্য সহজীকরণ, উন্নয়ন (এলডিসি ইস্যু) ও কৃষি। সদস্যরা একটা ভারসাম্যপূর্ণ সমঝোতার চেষ্টা করছে, যেন সবার স্বার্থ রক্ষিত হয়। তবে কৃষি খাতে বোঝাপড়া ছাড়া এ ধরনের কোনো সমঝোতা সফল হবে না। বাংলাদেশকে যেসব বিষয় প্রভাবিত করবে, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। উৎসবিধি ও সেবা খাতে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন সেগুলো মসৃণভাবে বাস্তবায়ন হলেই হয়। বাণিজ্য সহজীকরণ, বিশেষত ট্রানজিটে আমাদের উদ্বেগ রয়ে গেছে। আর শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধার ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু পাচ্ছি না।
তৌফিক আলী: ডব্লিউটিওতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী।
তৌফিক আলী: ডব্লিউটিওতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী।
No comments