এটা কি সিইসির স্ববিরোধিতা নয়? by বদিউর রহমান

বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমি আজতক কিছুই লিখিনি বলা চলে। লিখবই বা কেন, কমিশন যে রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্যতর ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত, না কি? তারপরও বিভিন্ন জন, রাজনৈতিক দলের কথা না হয় বাদই দিলাম, এ কমিশনকে মাঝেমধ্যেই একহাত নিতে ছাড়েন না। বিরোধী দল বাজাদ তো রকিব কমিশনকে অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন বলেই থাকে। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন শোনার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত যেমন হয়েছিলাম, তেমনি হতাশও হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম এজন্য যে আমি তাকে যতটুকু জানি সে হিসেবে তিনি সৎ, বেশ লেখাপড়াও জানেন, ধীরস্থির, ছাত্রজীবনে তো মেধাবী ছিলেনই, কর্মজীবনেও পাকিস্তানি তিন অক্ষরী সাহেব ছিলেন। অফিসের কাজে তিনি মনোযোগী ছিলেন, দায়িত্ব পালনে খুবই সচেতন ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্কও ভালো ছিল, সর্বোপরি ঊর্ধ্বতনদের বেশ প্রিয় ছিলেন। সচিব হিসেবেও তিনি আহামরি কিছু না হলেও সুনামের সঙ্গেই চাকরি সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু তার জাত-ভাইদের মতো ঠিকাদারি তথা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ তিনিও পছন্দ করেছেন। সরকারের অনেক সচিবই অবসরের পর আবার কোনো-না-কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েন; কেউ বলেন সময় কাটানোর জন্য, কেউ বা বলেন অর্থ উপার্জনের জন্য। তবে সচিব পদের পর তাদের পরবর্তী কর্মপদ সম্মানজনক বা মানানসই কিনা সেটা অনেকেই বাছবিচার করেন না। যারা এসব বাছবিচার করেন না তারা একদিকে কিন্তু ভালো, তারা সচিব পদটাকেও একটা চাকরি ভাবতেন, পরের চাকরিকে তা-ই ভাবেন। পাকিস্তানের এক প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা নাকি পরে হোটেলেও চাকরি করেছেন, আমাদের এক রাষ্ট্রপতিও নাকি পরে নিু কোনো পদের নির্বাচন করেছেন; অতএব কোনো সচিব যদি চাকরিরত অবস্থায়ই সচিব পদ থেকে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে যান সাবেক (খাদ্য সচিব বরুনমিত্র), কোনো অবসরপ্রাপ্ত সচিব যদি পৃথিবী গোল বিবেচনায় আবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি হন (এজেডএম সামসুল আলম), কিংবা অন্য কোনো সচিব যদি কোনো হাউজিং কোম্পানির এমডি হন অথবা কোনো সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবও যদি কোনো এনজিওতে চাকরি করেন, তাহলে তাদের দোষ দেবেন কেন? চাকরি তো চাকরিই, টাকা পেলেই হল, একটা গাড়ি পেলেই হল, বেকার তো আর থাকলাম না, কী বলেন? কত ডজন ডজন সচিব রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, কার খোঁজ কে রাখে? সেদিক বিবেচনায় রকিব সাহেব সরকারি চাকরির পর শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সম্মানজনক কাজেই জড়িত ছিলেন মর্মে শুনেছি। আমার ভালো লেগেছে।
কিন্তু তার সিইসি নিয়োগে হতাশ হয়েছিলাম এজন্য যে, সিইসির মতো দায়িত্ব, অন্তত আমাদের দেশে, পালনের জন্য যে সাহস প্রয়োজন তা তার ছিল বলে আমরা মনে করিনি। শুধু জ্ঞানী আর ভদ্রলোক হলেই কিন্তু সব হয় না, পদ-বিশেষে কোনো কোনো পদে একটু কম জ্ঞানী হলেও সাহসী মানুষ বেশি উপযুক্ত বটে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে তৎপরতা, ঊর্ধ্বতনদের প্রিয় হওয়া চাকরির বেলায় খুব প্রযোজ্য হয়তো হতে পারে, নিজের ভবিষ্যৎ তরক্কির জন্যও হয়তো এটা সুবিবেচ্য হতে পারে, বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন পাওয়ার জন্য তো এটা নির্ঘাত ভালো গুণ। কিন্তু সাংবিধানিক বড় গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য এসব গুণের চেয়ে সাহসের, বরং সৎ সাহসের একটা শক্ত অবস্থান বড় বেশি প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন এবং একটা নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি সৃষ্টিতে বর্তমান কমিশন যে সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে পারেনি, তা আমাকে অকপটে স্বীকার করতেই হচ্ছে। কমিশনের বেশ কিছু কার্যকলাপ কমিশনকে বিতর্কিত করেছে, দুর্বল প্রমাণ করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশনকে বড় (বাধংরাব) মনে হয়েছে। রাজনৈতিক একটা নাজুক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে নেতিবাচক কিছু লিখে প্রতিষ্ঠানটিকে ছোট করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না বলেই আগে কয়েকবার লিখতে গিয়েও লিখিনি, যাতে নাচুনে বুড়ি আবার যেন ঢোলের বাড়ি না পায়। এমনিতেই সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার প্রায়ই এবং সাবেক এক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ক্ষণে ক্ষণে যেভাবে এ কমিশনের কড়া সমালোচনা করেন, তাতেই বিএনপির পোয়া বারো, তার ওপর আবার আমরাও যদি কমিশনের ভুলভ্রান্তি এবং অদক্ষতা নিয়ে চিৎকার শুরু করি তাহলে অবস্থাটা কি ভালো ঠেকবে? তা-ই একবার প্রায় লিখতে গিয়ে কমিশনের এক কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কিছু বিষয়ে শেয়ার করেও পরে থেমে যাই। উদ্দেশ্য, কমিশন নির্বাচনটা সুন্দরভাবে করে দিক। পাঁচ সিটির নির্বাচনে কমিশন শুনামও কুড়িয়েছে বটে।
বর্তমান কমিশনের পাঁচজনের মধ্যে সিইসিসহ তিনজনকে অন্তত আমি জানি, চিনি। তাদের কর্মদক্ষতা এবং সুনাম সম্বন্ধেও আমি অবগত। কিন্তু সার্বিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড কমিশনের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক তো হয়ইনি, বরং কমাতে সহায়ক হয়েছে বলা চলে। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ সম্পর্কিত এক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট আসনের একজন ভোটার হিসেবে আপত্তি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং বক্তব্য রেখেছিলাম। কমিশনের প্রস্তাবিত সীমানা পুনঃনির্ধারণের কিছু বিষয় আমার কাছে কমিশনের নীতিমালার আলোকেই অপ্রয়োজনীয় এবং অনভিপ্রেত ঠেকেছে। পূর্বে সীমানা যদি প্রতিষ্ঠিত নীতিমালায় যথাযথ থেকে থাকে, তাহলে নতুন একটা কিছু করার অপ্রয়োজনীয়-পরিবর্তন ভালো ফল আনে না। শুনানির পর ফের পূর্বাবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে গেলেও কোনো কোনো পরিবর্তন অযৌক্তিক এবং মনগড়া ঠেকেছে। ঢাকা-১৪ আসনের সঙ্গে সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নকে যুক্ত করা নিয়ে যার পর নাই সমালোচনা হয়েছে। এমনও শোনা গেল যে, কোনো এক কমিশনারের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় নাকি তা হয়েছে। বড়ই দুঃখজনক বটে। অথচ কাউন্দিয়া ইউনিয়ন এ আসনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনোই গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই, সীমানা নির্ধারণের বিবেচ্য অনুষঙ্গগুলোর আলোকেও কোনো ভিত্তি নেই। তখন আমার মনে হয়েছে, কমিশন গায়ে পড়ে ঝামেলা সৃষ্টি করছে। আবার কমিশনের এক ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পক্ষে (যদিও পরে সমালোচনার কারণে আর হয়নি) দেয়া উদ্ভট যুক্তি হাস্যকরই হয়েছিল যেন। সর্বশেষ এক আইনি সংশোধনেও কমিশনকে যেন নীরব ভূমিকায় থাকতে দেখা গেল। ফলে মনোনয়ন জমা দেয়ার একদিন আগে কোনো দলের সদস্য হয়েও সে দলের প্রার্থী হতে আর বাধা থাকল না। বড় চমৎকার না, সত্যি গণতন্ত্র বলে কথা যে!
আজ নির্বাচন কমিশন নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাদের ছোট্ট বেলায় পাকিস্তান আমলের রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান নিয়ে করা এক মশকরার কথা মনে পড়ল। এক বাচ্চা নাকি কী জন্য রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন হরেক কৌশল করেও তাকে কথা বলাতে পারছে না। সবাই বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, না জানি বাচ্চাটার জবানই বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তার ডাকা হয় আর কী! লোভ-লালসা, খেলনা-খাবার-কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। তখন এক মুরব্বি বললেন, তিনি বাচ্চাকে কথা বলাতে পারবেন। সবাই তো অবাক, বলে কী! হাতি-ঘোড়া গেল তল, গাধা বলে কত জল- অবস্থা যেন। তিনি বাচ্চার কানে কানে গিয়ে বললেন, রেডিও পাকিস্তানের কিছুক্ষণ পরের অনুষ্ঠানটা তোমার খুব ভালো লাগবে। একটা রেডিও আনা হয়েছে। অমনি বাচ্চা নাকি চিৎকার করে ‘না, না, আমি শুনব না’ বলে উঠল। হুবহু বলতে না পারলেও মশকরাটা এ রকমই- রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান বাচ্চাও নাকি অপছন্দ করত। এখন পাঠক জানতে চাইতে পারেন- সিইসির সঙ্গে এ মশকরা-গল্পের সম্পর্ক কোথায়। উত্তরে আমি বলব, আমি তো নির্বাচন কমিশন নিয়ে লিখতেই চাইছিলাম না, যত ভুলভ্রান্তি ও অপক্বতার পরিচয়ই কমিশন দিয়ে থাকুক না কেন। ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ নীতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর, সবার অংশগ্রহণে বিশ্বাসযোগ্য করে দিতে পারলেই হল। সে আশায় বুক বেঁধেই তো চুপ করে ছিলাম। তফসিল ঘোষণার আগের দিনও যখন সিইসি বললেন, তারাও সমঝোতার জন্য সময় দিতে আগ্রহী, তখন তো আমরা আশার আলোই দেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, সিইসির ওই বক্তব্যের পর একদিনও না যেতে তার তফসিল ঘোষণা!
এই-ই যদি হবে, আগের দিন ভিন্ন কথা কেন তবে? অন্তত আরও দু-চারটা দিন অপেক্ষা করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এ তফসিল ঘোষণা তার অবশ্য কর্তব্য বটে। কিন্তু তিনি নিজে যে-কথা বললেন তা কেন রাখলেন না? তিনি কি কোনো চাপে ছিলেন? থাকলেও তো তার নিজের কথা ঠিক রাখা তার আরও বড় কর্তব্য ছিল, না কি? আগে তিনি বা তার কমিশন যা-ই করেছেন, কমিশনের ভাবমূর্তি তুলনামূলকভাবে যত সমালোচনার মুখেই ফেলেছেন, সবই আমরা হজম করেছি বড় পাওনার আশায়। অবশ্যই এটা মানব যে, বিএনপি সমঝোতায় না এলে তিনি তফসিল সময়মতো ঘোষণা করতেই পারতেন। কিন্তু একটু সমঝোতার সুযোগ দেয়ার কথা বলে তা থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে আসা তাকে, তার কমিশনকে বড় বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদি সমঝোতার চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও তিনি বা কমিশন এটা করে থাকেন, যদি প্রয়োজনে তফসিল আবার পেছানোর ইচ্ছা নিয়েও এটা করে থাকেন, যদি সময়ের নিরাপদ অবস্থানে থাকার কৌশলেও এটা করা হয়ে থাকে, তবুও বলব ওয়াদা দিয়ে, সময় দেয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ্য ঘোষণায় বলে এমন পশ্চাদপসারণ তার এবং কমিশনের সদিচ্ছাকে, ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিশ্বাসযোগ্যতাকে খাটো করেছে। এতে আমার হতাশার প্রমাণ মিলল বটে। এখন অন্তত আশা করি, তিনি বাকি কাজগুলো অবশ্যই বুঝে-শুনে ভালোভাবে করবেন, যাতে আর কোনো হতাশা আমাদের না হয়।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.