মেঘলার আকাশে রাতের আঁধার! by এস এম আব্বাস

মুঠোভর্তি চকচকে দুই টাকা আর পাঁচ টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে আছেন বাবুল মিয়া। সমঝদার এক শ্রোতা দৃষ্টি মেলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আসরের সামনে।
নাচের মুদ্রায় শরীর দুলিয়ে মেঘলার গান শুরু হলেই আর্শীবাদের মতো ঝরে পড়বে সেই চকচকে নোটগুলো।

দু’হাতে টাকা কুড়ানোর অপেক্ষার তর (দেরি) যেন সইছে না বাবুলের! শুরু হলো, মেঘলার গান। বাবুল মিয়ার চোখ-মুখে উপচে পড়ছে আনন্দ।

রাজধানীর মিরপুরে শাহ আলীর মাজারে বৃহস্পতিবার রাতে মজমার মধ্যে কথা হচ্ছিল মেঘলার বাবা বাবুল মিয়ার সঙ্গে। নবম শ্রেণীতে পড়া মেঘলার বয়স চৌদ্দ ছুঁয়েছে। তার গান শুরুর পর বাবুল মিয়া আনন্দের সঙ্গে জানালেন, প্রতিরাতে ছয় থেকে আট হাজার টাকা ওঠে। তবে অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়, বাদক দলকে।

কম বয়সী ছেলেরা নতুন চকচকে দুই টাকা, আর পাঁচ টাকা মেঘলার গায়ে ছিটিয়ে দিতে থাকে। কেউ কেউ কাছে এসে একটা একটা করে নোট ছুড়ে দেয় হাতে। হাত ভর্তি টাকা বাবার দিকে ছুড়ে দেয় মেঘলা। সেগুলো কুড়াতে থাকেন বাবুল মিয়াসহ আসরের লোকজন।

টাকা কুড়ানোর এক ফাঁকে বাবুল মিয়া জানান, রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় খানকার বাড়ির উত্তরের দিকে একটি চায়ের স্টল রয়েছে তার। তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই, প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে মাজারে আসর জমাই।

প্রতি রাতে আট হাজার টাকা ওঠে মজমা থেকে। পকেটে আসে চার হাজার টাকা। এখনো রাতের খানিকটা বাকি, বেশিও উঠতে পারে।

এর আগে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নানা অঙ্গভঙ্গিতে গান করেছেন রিমু সরকার। দর্শকরা যেন হামলে পড়েছিল। টাকাও উঠেছে অনেক।

বাবুল মিয়া জানান, রিমু সরকার এই লাইনে পাকা। কীভাবে দর্শকদের কাছে টানতে হয়, তার শেখা হয়ে গেছে। কিন্তু, আমার মেয়ে ছোট। এই লাইনেও নতুন। তবে সুরেলা কণ্ঠ তার।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে না থাকলেও সুরেলা কণ্ঠ আর মমতাময়ী মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকেই সহায়তা করে তাকে। আসরের আরেকজন বাবুলের কথার ফাঁকে জানালেন, মেঘলার বয়স কম। তাই, কম বয়সী ছেলেদের ঝোঁক তার দিকে বেশি।

শেষ রাতের দিকে ছোট ছেলে জহির মজমার আসরেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবুল মিয়া জানান, জহির খুব ভালো হারমোনিয়াম বাজায়।

সংসারের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় মেয়ে নাসিমার বিয়ে দিয়েছি। মেঘলা কল্যাণপুর একাডেমিতে গান শেখে। জহিরের ছোট তসলিমা নামে আরো একটি মেয়ে রয়েছে তার।’

গান শুরুর আগে কথা হয়, মেঘলার সঙ্গে। মেঘলা জানায়, সে শহীদ শাহাবুদ্দিন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়ে। সে ছাড়া পরিবারের আর উপার্জনের তেমন কেউ নেই।

গত বৃহস্পতিবার রাতে মেঘলার মতো অনেক মেয়েই কম বয়সে গান গইতে আসেন মিরপুরের শাহ আলীর মাজারে। তবে সবাই কম বয়সী নয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীরাই মজমা করে টাকা উপার্জন করে। তবে অনেক মজমাই রয়েছে, গুরুভক্তি আর গুরু বন্দনার জন্য।

প্রায় অর্ধশত গানের মজমা চলে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে। শাহ আলীর ভক্তদের আরাধনা, ধুপ-ধোঁয়া, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন চলে সরারাত। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে গাঁজার আসর।

হাজার হাজার মানুষের সমাগমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মনোহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন ফেরিওয়ালারা।

পাঁচ থেকে সাত হাত দূরে আবার কোথায় গায়ে-গায়ে লাগা মজমার আসরে সাউন্ডবক্স বা মাইকের শব্দ। সঙ্গীতের কোনো পরিবেশ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। মনে হবে, মেলার হল্লা-চিল্লা।

এই মেলায় কেউ টাকা উড়াচ্ছেন, আর কেউ কুড়াচ্ছেন। এই টাকা কুড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে অনেক বাবাই তার ছোট শিশুকে আসরে তুলছেন। এটিকেই যেন পেশা হিসেবে নিয়েছেন অনেকে। মেঘলা তাদেরই একজন।

কিন্তু, মেঘলা বাংলানিউজকে জানায়, সে লেখাপড়া করতে চায়। রাতের এই আঁধার থেকে দিনের আলোয় বেরিয়ে আসতে চায় সে। সে সুন্দর করে জীবন সাজাতে চায়। কিন্তু, কিছুই করার নেই তার।

শাহ আলীর মাজারে রাতের সচেতন দর্শনার্থীদের মন্তব্য সামান্য স্বচ্ছলতার জন্য মেঘলার আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে সে অন্ধকারে। জন্মদাতা বাবারও সে বোধ নেই। কী হারাচ্ছে সে! তিনি শুধু বোঝেন, দু’বেলা খাবার নিশ্চয়তা আর সামান্য স্বচ্ছলতা!

No comments

Powered by Blogger.