গল্প- জাদুর কলম by অর্ঘ্য দত্ত

আমাদের ক্লাসের অনীককে তো তোমরা চেনো। ওর রোল ৫০। ও বরাবরই সবার থেকে পিছিয়ে আছে।
কিন্তু কী আশ্চর্য, এবার ক্লাসটেস্ট, হোমওয়ার্ক, ক্লাসওয়ার্ক সবকিছুতেই ওর নম্বর সবার চেয়ে বেশি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্ম, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান—সব বিষয়েই ওর ফুল মার্ক। ওর নম্বর দেখে আমরা সবাই অবাক। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের গালে হাত, অনীক হঠাৎ বদলে গেল কী করে?


ক্লাসে অনীক আমার পাশেই বসে। একদিন আমিই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে অনীক, ঘটনা কী?’ অনীক বুঝেও না বোঝার ভান করল। বলল, ‘কিসের আবার ঘটনা?’

আমি বললাম, ‘তুই ভালো রেজাল্ট করেছিস, এটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু কীভাবে?’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে অনীক বলল, ‘ও কিছু না, ও কিছু না। এমনিতেই হয়েছে।’

ভাবলাম, হতেও পারে। হয়তো ভালো পড়াশোনা করেছে বলেই ভালো ফল পেয়েছে। কিন্তু রেজাল্টের ব্যাপারে ওকে প্রশ্ন করলে ও কিছুই বলতে চায় না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা সবাই মেনেই নিয়েছিল। পরে কেউ আর প্রশ্নও করেনি, কিছু জানতেও চায়নি। কিন্তু তৃতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ওর রেজাল্ট দেখে সবার চোখ কপালে উঠল! সব বিষয়ে এ প্লাস! যার পক্ষে সব বিষয়ে ‘বি প্লাস’ পাওয়া কঠিন, সে কিনা রাতারাতি সব বিষয়ে ‘এ প্লাস’ পেয়ে গেল! সবার মনে এবার একটাই প্রশ্ন, এত ভালো রেজাল্টের পেছনে রহস্যটা কী?

এবার সবাই মিলে অনীককে ধরে বসলাম। ‘বল না, কেমন করে তুই এমন বদলে গেলি? তুই ভালো রেজাল্ট করেছিস, তুই এখন আমাদের ক্লাসের গর্ব। তোর কাছে টিপস পেলে আমরাও ভালো রেজাল্ট করতে পারব। তুই কি বন্ধুদের ভালো চাস না?’

অনেক বলার পর শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল অনীক, ‘শোন তাহলে।’

তারপর শুরু করল প্রথম ক্লাস টেস্টের আগের রাতের গল্প । ‘সে রাতে প্রচণ্ড ঝড় হয়েছিল।’ অনীক বলতে শুরু করা মাত্রই রাজু ওকে থামিয়ে দিল। বলল, ‘আরে সে রাতে ঝড়ের কথা তো জানি। নতুন কিছু বলার থাকলে বল।’

সঙ্গে সঙ্গে রাজুর মাথায় একটা চাটি মারল অনীক। বলল, ‘তোর যদি শুনতে ভালো না লাগে চলে যা। বিরক্ত করিস না।’

আমরাও বললাম, ‘তাই তো। ওকে গল্পটা আগে শেষ করতে দে।’

অনীক মাথা নেড়ে বলল, ‘আহা! এটা কোনো গল্প না। সত্যি ঘটনা।’

আমরা বললাম, ‘বেশ তো, বল।’

অনীক আবার শুরু করল। ‘পরীক্ষার আগের রাত। বুঝতেই পারছিস, পড়াশোনা ছাড়া কোনো দিকেই আমার খেয়াল ছিল না। কখন ঝড় শুরু হয়েছে, জানিও না। হঠাৎ দেখি, পড়ার ঘরের দরজা খুলে গেল। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়। দরজা বন্ধ করতে গিয়েছি, দেখি বারান্দায় একটা কলম পড়ে আছে।’

রাজুকে চাটি মেরে ক্লাসরুমের বাইরে পাঠিয়েছিল অনীক। কিন্তু রাজু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব শুনেছে। এবার জানালার ওপাশ থেকেই মুখ বের করে বলল, ‘কলমটা কেমন ছিল রে?’

পেছন থেকে আচমকা রাজুর কথা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। অনীকের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। ও বলেই চলেছে। ‘কী করলাম তারপর জানিস? কলমটা তুলে নিলাম। ঘরে এনে আলোর সামনে ধরে দেখি, বাহ্ খুব সুন্দর, একেবারে নতুন!’

‘ওটা নিশ্চয়ই ফাউন্টেন পেন ছিল?’ জানালার বাইরে থেকে আবারও রাজুর বেয়াড়া প্রশ্ন। অনীক তো রেগে আগুন। ‘কেন, ফাউন্টেন পেন হবে কেন?’

মাথা চুলকে রাজু বলল, ‘গল্পের লেখকেরা পুরোনো দিনের মানুষ। তাই গল্পের কলমগুলো এ রকমই হয়।’

রাজুর কথা শুনে অনীক আবারও রেগে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘তার মানে তোদের ধারণা এটা গল্প?’

আমরা অনীককে ঠান্ডা করি, ‘এটা রাজুর ধারণা হতে পারে, আমাদের নয়। তুই বল।’

শান্ত হয়ে অনীক বলল, ‘কলমটা দিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম, লেখা হলো না, কলমে কালি নেই। কী আর করা, শেষ পর্যন্ত কলমটার স্থান হলো ময়লার ঝুড়িতে। রাতে শোয়ার সময় ভাবলাম, কলমটা তুলে রাখি। কিন্তু আবার ভাবলাম, কী দরকার!’

‘তারপর, তারপর?’ আমরা বলি।

‘সে রাতেই আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। মনে হলো কে যেন এসে আমায় বলছে, আমার প্রজা “ইয়ান” অভিযোগ করেছে, কলমের কালি শেষ না হতেই তুমি কলম ফেলে দাও। আমি বললাম, লেখা না হলে সেই কলম দিয়ে আমি কী করব। এক কোটি মার্কিন ডলার দামে কলমটা নিলামে তুলব নাকি?’

‘এই অনীক, এক কোটি মার্কিন ডলারে বাংলাদেশের কত টাকা হয় রে?’ জানালার ওপাশ থেকে আবারও রাজুর প্রশ্ন।

রাজুকে পাত্তা না দিয়ে অনীক বলল, ‘স্বপ্নের লোকটা আরও কী বলল জানিস? বলল, “ইয়ানকে ময়লার ঝুড়ি থেকে তুলে ফেলো আর ওই কলমটা দিয়েই তোমার ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা দাও।” ব্যস, ঘুম ভেঙে গেল। ময়লার ঝুড়ি থেকে কলমটা তুলে দেখি কলমের ক্যাপে ছোট্ট করে লেখা, ইয়ান।’

জানালার ওপাশ থেকে রাজু বলল, ‘নিশ্চয়ই চায়নিজ কলম!’

এবারও অনীক রাজুর কথার উত্তর দিল না। বলল, ‘আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই “ইয়ান” কলমে পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছি তাতেই ফুল মার্ক পেয়েছি!’

সত্যিই এটা সম্ভব! আমরা যখন সবাই এমন ভাবছি, ঠিক সেই মুহূর্তে জানালার বাইরে থেকে রাজুর চিৎকার, ‘থ্যাংকস মিস্টার অনীক! এই গল্প বলে আপনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের সেরা মিথ্যুক হিসেবে নাম লেখালেন।’

রাজুর কথা শুনে অনীকের তখন ভীষণ রাগ। ওকে ধরার জন্য ক্লাসের বাইরে ছুটে গেল অনীক। আমাদের আর জানাই হলো না আসল রহস্যটার কথা। পড়াশোনা ছাড়া কলমের জাদুতে পরীক্ষার রেজাল্ট কখনো বদলানো যায়?

অর্ঘ্য দত্ত

লক্ষ্মীবাজার সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ২০১১ সালে ঐতিহ্য-গোল্লাছুট-প্রথম আলো গল্প লেখো প্রতিযোগিতায় বিজয়ী।

No comments

Powered by Blogger.