দক্ষিণ ফিলিপাইনে অধরা শান্তি by আবু হুরাইরাহ্

ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ফিলিপাইনে সরকার ও বৃহত্তম মুসলিম বিদ্রোহী গোষ্ঠী মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের (এমআইএলএফ) মধ্যে মাত্র গত বছর স্বাক্ষরিত হয়েছে ঐতিহাসিক এক শান্তিচুক্তি।
এর ফলে দীর্ঘ ৪০ বছরের সংঘাত-সহিংসতার অবসানের মাধ্যমে দেশটিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম-অধ্যুষিত দক্ষিণ ফিলিপাইনে আরেক মোরো বিদ্রোহী সংগঠন মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (এমএনএলএফ) সঙ্গে সরকারি বাহিনীর গত সপ্তাহে শুরু হওয়া ভয়াবহ সংঘর্ষ সে আশায় সংশয়ের ছায়া ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটিতে আদৌ স্থায়ী শান্তির দেখা মিলবে কি না, তা নিয়ে।

প্রেসিডেন্ট অ্যাকুইনো ও এমআইএলএফের নেতাদের মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ফিলিপাইনের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আরও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ রক্তপাতের অবসান ও দেশটির সর্বদক্ষিণের দ্বীপ মিন্দানাওয়ে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার পথ প্রশস্ত হয়। চুক্তিটি এখনো বহাল রয়েছে। তবে সাম্প্রতিকতম সংঘাত এ আশঙ্কা জাগিয়েছে যে অস্থিরতাপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, দল-উপদল ও হতাশ হয়ে পড়া বিদ্রোহীদের নানা পক্ষ শান্তি-প্রক্রিয়াকে বিপথে ঠেলে দিতে পারে।
বেনিগনো অ্যাকুইনো গত শুক্রবার জাম্বোয়াঙ্গা সফর করেন। এ শহরের সহিংসতা নিয়ে তিনি তাঁর গত তিন বছরের শাসনামলে অন্যতম বড় নিরাপত্তা-সংকটের সম্মুখীন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দমনাভিযান চালাবেন, নাকি তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন, সে বিষয়ে তাঁকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, প্রেসিডেন্ট দমনাভিযানের সিদ্ধান্ত নিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার আলোচনার উদ্যোগ নিলেই যে সমাধান হাতের কাছে, তা-ও নয়।
সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে এই মুহূর্তে বিরাজ করছে গভীর অবিশ্বাস। জাম্বোয়াঙ্গায় চলমান সংঘর্ষে দুই পক্ষই একপর্যায়ে অস্ত্রবিরতির ব্যাপারে একমত হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা ভেঙে পড়ে। এ জন্য উভয় পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। বিদ্রোহীদের দখল করা শহরের কয়েকটি এলাকায় অন্তত ১০০ বাসিন্দাকে জিম্মি করা হয়।
বন্দর শহর জাম্বোয়াঙ্গায় আট লাখ লোকের বসবাস। এটি ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ মিন্দানাওয়ে অবস্থিত। দেশের মোট খনিজ সম্পদের দুই-পঞ্চমাংশই রয়েছে মিন্দানাও দ্বীপে। দেশের ষষ্ঠ জনবহুল ও তৃতীয় বৃহত্তম শহর জাম্বোয়াঙ্গা। এমএনএলএফের বিদ্রোহীরা গত সপ্তাহে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে স্বাধীনতার পতাকা ওড়াতে শহরটির কেন্দ্র অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে এ নিয়েই সংঘাতের সূত্রপাত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাম্বোয়াঙ্গার সহিংসতা গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এক সতর্কবার্তা। খনিশিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহিংসতা শুরুর আগে বলেছিল, এমআইএলএফের সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছিল। তবে পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে গেছে।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাজিব বিশ্বাস বলেন, যদি সহিংসতা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে বা দ্বন্দ্ব আরও বিস্তার লাভ করে, তবে তা নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে মিন্দানাওয়ের প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
জাম্বোয়াঙ্গায় যেসব বিদ্রোহী লড়াই করছে, তারা এমএনএলএফের একটি অংশ। এ অংশ ১৯৯৬ সালে সরকারের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তিতে সই করে, যা কখনোই তেমন টেকসই হয়নি। এ উপদলের নেতা নূর মিসুয়ারি (৭১) মূল এমএনএলএফ থেকে ২০০১ সালে বেরিয়ে যান। সরকারের সঙ্গে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের চুক্তি করা এমআইএলএফকে গত বছর হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে সংগঠনটি নিজের ‘মৃত্যু পরোয়ানাতেই’ সই করছে।
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রোডোলফো গার্সিয়া বলেন, সরকারের উচিত মিসুয়ারির সঙ্গে আলোচনায় বসা; যদিও তিনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় কোনো ভূমিকা রাখার কথা অস্বীকার করেছেন। ব্যবসায়ী নেতা সোলিভান বলেন, এমএনএলএফের প্রতিষ্ঠাতাকে অবমূল্যায়ন করে সরকার সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছে। মিসুয়ারি এখন আগের মতো শক্তিশালী না হতে পারেন, কিন্তু তিনি এখনো ফিলিপাইনের মুসলমানদের সংগ্রামের নায়ক।

No comments

Powered by Blogger.