টুকরো আয়নায় by শওকত আলী

শওকত আলী, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
নিজের জীবনের কথা বলা বা লেখা আত্মজীবনীই হয়ে পড়ে। আত্মজীবনী লেখার কথা যথাসময়ে ভাবিনি, এখন লেখার চেষ্টাও করি না। তবে মাঝেমধ্যে যা লিখেছি, তাতে নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি কম হোক বা বেশি হোক, কিছুটা এসেছে। ঘটনার বিন্যাসে, চরিত্র সৃষ্টিতে, বক্তব্যে সময়ের সমাজের এবং মানুষের কথা যতটুকু এসেছে, তা আমার অভিজ্ঞতাজাত। এমনকি কল্পনার আশ্রয়ে যে জীবন ও ঘটনার অবতারণা করেছি, তার ভিত্তিও বাস্তবতানির্ভর—ইতিহাসভিত্তিকও বলা যায়। অবশ্য এ জন্য আমি কোনো কৃতিত্ব দাবি করি না। কারণ, সাহিত্যজগৎ যে একটি বিনির্মাণ, তা তো অস্বীকার করা যায় না। যে সময়ে জীবনকে দেখতে শুরু করেছি, সেই সময় এবং দেখার বিষয়বস্তু তো লেখার মধ্যে আপনা থেকেই এসে যায়, অথবা লেখককে তা বের করে আনতে হয় জীবনোপলব্ধি থেকে। লেখকের কর্তব্য-কর্মও তাই। লেখকের রচনায় আকাশ-পাতাল কল্পনা থাকলেও তাঁর রচনার বিষয় ও ঘটনাবলির মধ্যে মানুষের জীবনের বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উঠে আসে। রায়গঞ্জ নামের এক উপজেলা শহরে আমার জন্ম। ১৯৪৭-এর আগে এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলা প্রদেশের দিনাজপুর জেলায়।
এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা শহর। পূর্বপুরুষের যাবতীয় উত্তরাধিকার ছেড়ে নতুন রাষ্ট্র তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ববাংলার জেলা শহর দিনাজপুরে আমরা চলে আসতে বাধ্য হয়েছি সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। এরপর থেকে সেখানে অবস্থান করছে আমাদের পরিবারের এক অংশ। আর বাকি অংশ ঠাঁই গেড়েছে নানা জায়গায়। বড় ভাই মোহাম্মদ আলী সরকারের বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা রংপুর। সেজ ভাই চিকিৎসক জামান আলী সরকার পুত্র-কন্যা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে লন্ডনে। অন্যদিকে আমার বড় ছেলে স্ত্রী-সন্তানসহ বর্তমানে মার্কিন মুল্লুকের বাসিন্দা। আর অন্য দুই ছেলেসহ ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছি আমি। এ ছাড়া আমার প্রয়াত বড় বোনের পরিবারও এখন রাজধানীর বাসিন্দা। অর্থাৎ আমরা ছড়িয়ে আছি দেশে-বিদেশে, নানা জায়গায়। মনে পড়ে, দিনাজপুরের শহরে বসবাসের সময় জড়িয়ে পড়েছিলাম ছাত্ররাজনীতিতে। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঘটনা তরুণসমাজকে প্রচণ্ড আলোড়িত করেছিল। দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি জোরালো হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত তখন থেকেই। বাংলা ভাষা আর বাঙালির জীবনকে যে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নিই, ক্রমেই সেটি সুস্পষ্ট হতে শুরু করল। তখন দিনাজপুর জেলা শহরের একমাত্র উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল সুরেন্দ্রনাথ কলেজ। আমি ছিলাম এই কলেজের ছাত্র। ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন সে সময় সবে গড়ে উঠছে। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা আকর্ষণ করছে তরুণসমাজের মন। আমরা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করতাম। সে সময় দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা গঠন করা হয়। পরবর্তীকালের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মানিত নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ তখন ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যমী সংগঠক হয়ে ওঠেন। আমার থেকে তিনি এক ক্লাস নিচে পড়তেন—আইএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন।
সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনে অগ্রবর্তী ভূমিকা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের। এই সংগঠনের সঙ্গে আমার যুক্ততা ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের উত্থান, পাকিস্তানপন্থীদের পরাজয় এবং মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠায় পূর্ব বাংলায় ৯২/ক ধারা জারি করে সরকার। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। আমাদের দিনাজপুরেও ধরপাকড় শুরু হলো। ফলে বাধ্য হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন অনেকেই। তার পরও বহু কর্মী ও নেতাকে জেলখানায় ঢোকানো হলো। ধরা হলো প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতাদের, আওয়ামী লীগের নেতাদেরও। এমনকি ধরপাকড় থেকে বাদ পড়লেন না ছাত্ররা—সে সময় জেলবাসের অভিজ্ঞতা আমারও হয়। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ইচ্ছা একাধিকবার হয়েছিল—দু-একটা গল্পও লিখেছি, কিন্তু এর বেশি কিছু লেখা হয়নি। তখন ভাবতাম, আত্মজীবনীতে জেলজীবনের অভিজ্ঞতার কথা লিখব। কিন্তু এখনো তা লেখা হয়নি; আর হবে বলেও মনে হয় না। এখন তো মগজে—স্মৃতির দরজায় তালা পড়ে গেছে। কারাবাসের সময় তেভাগা আন্দোলনের সামনের সারির নেতা-কর্মীর সঙ্গে একত্রে থাকার সুযোগ হয়েছিল। এতে নিজের কিছু লাভও হয়েছে—তাঁদের কাছে আন্দোলনের ঘটনাস্থলগুলো সম্পর্কে জেনেছি। পরে সরেজমিনে সেই সব জায়গা দেখেও এসেছি। আমার কোনো কোনো গল্পে ওই সব স্থানের কথা আছে। জেলজীবনে আমার অবস্থান পুরো এক বছরও নয়। কেননা, মনে আছে, ছাড়া পাওয়ার পরই বিএ ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণের সুযোগ পাই। পরীক্ষার জন্য অবশ্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। তবে পাস করে যাই একবারেই, ১৯৫৫ সালে। রেজাল্ট থার্ড ডিভিশন। সময়টা আমাদের এ রকমভাবেই গিয়েছে। সচেতন ছাত্ররা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছে এবং স্কুলের পরীক্ষায় ভালো করলেও পরে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তেমন ভালো ফল অর্জন করতে পারেনি।
আমি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও লেখালেখির চেষ্টা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার আগেই আমার কিছু লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সুবাদে আহসান হাবীব, সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমানের মতো কবি ও লেখকদের সঙ্গে জানাশোনা হয়। তাঁরা লেখার জন্য প্রতিনিয়ত আমাকে উৎসাহিত করতেন এবং পত্রিকায় আমার লেখা ছাপাও হচ্ছিল। এখানে লেখা দরকার যে ঢাকায় পড়াশোনা করার সময় গৃহশিক্ষকের কাজ করতে হতো আমাকে। বিএ পাসের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ভর্তি হই এমএ ক্লাসে। কিন্তু ১৯৫৫ সালে ভর্তির বছরেই আমাকে দিনাজপুরে ফিরে যেতে হয়। কারণ অন্য কিছু নয়, টাকা-পয়সার অভাব। পরের বছর আবার ঢাকায় এসে গৃহশিক্ষকতা ও দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় চাকরির সুযোগ পেলাম। ভাগ্যে জুটে গেল তখনকার ঢাকা হলে থাকার জায়গাও। এখানে টেনেটুনে কাটল দুই বছর—এমএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গন্তব্য আবার দিনাজপুর। ওখানে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলাম অল্পদিন; কিন্তু ভালো লাগেনি। কারণ, শিক্ষকতায় সে সময় বেতন ছিল খুবই কম। আর রাজনীতি করার কারণে আমার পেছনে পুলিশের খবরদারি তো ছিলই। তাই আবারও ঢাকায় ফেরা। এ সময় সিকান্দার আবু জাফর আমাকে সমকাল পত্রিকা দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললে রাজি হই আমি। কিন্তু এ যাত্রায়ও বেশি দিন থাকতে পারিনি ঢাকায়। দিনাজপুরে ভাইবোনেরা নানা ঝামেলায় পড়েছিল। সুতরাং আবার ফেরতযাত্রা। নতুনভাবে ফের মাস্টারির চাকরি—বীরগঞ্জ হাইস্কুলে মাস্টারি; হেডমাস্টারের দায়িত্ব নিতে হলো কয়েক মাসের জন্য। তত দিনে ঠাকুরগাঁওয়ে নতুন কলেজ খোলা হয়েছে। আমি সেখানে দরখাস্ত করলাম, কিন্তু ইন্টারভিউয়ে ডাকা হলে যেতে পারিনি।
তখন আমি ব্রেইন ফিভারে আক্রান্ত। রোগমুক্ত হয়ে গেলাম ঠাকুরগাঁওয়ে। জানলাম, বাংলা বিভাগে তখনো শিক্ষক নেওয়া হয়নি। তো, ঠাকুরগাঁও কলেজে আমার চাকরি হয়ে গেল। সেখানে কাটল প্রায় দুই বছর। এই চাকরির সময়েই বিয়ে করলাম। বিয়ে হলো ঢাকায়। পাত্রী আমার বন্ধুর বোন। ওরা কলকাতার লোক। আমাদের দুজনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দিনাজপুরেই। তখন সে ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। আমাদের দুজনের নামের মিল আশ্চর্য রকমের—বলা যায় একই রকমের—আমি শওকত আলী আর ওর নাম শওকত আরা বেগম। বেশি দিন আমার ঠাকুরগাঁওয়ে থাকা হয়নি। তত দিনে ঢাকা থেকে লেখালেখির তাগিদ বেড়ে গেছে। অতএব চলো, ঢাকায় যাই—ওখানে যদি কিছু পাই...। ঢাকায় এলাম প্রথমে একাকী। রোজগারের পথ খুঁজছি। এর মধ্যে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুল, জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক নেওয়া হবে। হাসান হাফিজুর রহমানের মুখে শুনলাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ লন্ডনে যাচ্ছেন পিএইচডি করতে। তাঁর জায়গায়ই নেওয়া হবে নতুন শিক্ষক। দরখাস্ত করলাম, ইন্টারভিউ দিলাম—চাকরিও হয়ে গেল। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে জগন্নাথ কলেজে চাকরি শুরু। সেই থেকে ঢাকা শহরেই রয়ে গেছি। জগন্নাথে কেটেছে ২৫ বছর। যখন চাকরি শুরু করি, কলেজে চালু ছিল ডিগ্রি কোর্স। এরপর কলেজের নাম হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’—অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয় তখন। জগন্নাথ কলেজে আমার যোগদানকালে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। এ ছাড়া সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম হাসান হাফিজুর রহমানকে। ক্রমে আরও কয়েকজনকে পেলাম সহকর্মী হিসেবে।
এঁদের মধ্যে মমতাজউদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান, হারুন অর রশিদের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। নামগুলো উল্লেখ করলাম এ জন্য যে আমার কর্মস্থল বা জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রটি ছিল লেখালেখির জন্যও সহায়ক। কাজের চাপ থাকলেও তাতে কখনো নিজের লেখালেখি বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। এখানে আমার আরেকজন সহকর্মীর নাম সম্মানভরে উচ্চারণ করতে হবে—কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর সঙ্গে আমার আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘকাল। বেশ কিছু দিন ধরে কোনো রকম লেখালেখি করতে পারছি না আমি। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, চিকিৎসাধীন রয়েছি—ছেলের বাসায় থাকি। এখন পুরোনো দিনের কথা পুরোপুরি স্মরণ করতে পারি না। তবু লিখতে সাধ হয়। তাই লেখাটি লিখলাম। এ লেখায় নিজের জীবনের নানা স্মৃতি লিখতে গিয়ে, স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঠে হাঁটতে হাঁটতে আমি যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি, সে আয়না চূর্ণ-বিচূর্ণ, টুকরো-টুকরো!

No comments

Powered by Blogger.