ওরা ভয়ঙ্কর নারী!

ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়াচ্ছে নারীরা। ছিনতাই, ডাকাতি, প্রতারণার ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। সমপ্রতি খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সহযোগী হয়ে উঠেছে নারী অপরাধীরা।
র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের জালে আটক হওয়া একাধিক নারী অপরাধী অকপটে স্বীকার করেছে তাদের সেসব অপরাধের কথা। বর্ণনা করেছে একজন নারী হয়ে কিভাবে আরেকজন নারীকে ফাঁদে ফেলে তুলে দেয় ধর্ষকদের হাতে। রেন্ট-এ কারের গাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তা বিক্রি করে দেয়া, ম্যারেজ মিডিয়ার পাত্রী সেজে ধোঁকা দিয়ে একাধিক পুরুষকে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও অফিস কর্মকর্তাকে ফাঁদে ফেলে সন্ত্রাসী লেলিয়ে টাকা আদায়, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে নারী কর্মীদের লাগিয়ে ডাকাতি, রাস্তাঘাটে ছিনতাইসহ সব অপরাধকাণ্ডে দিনে দিনে বাড়ছে নারীর সম্পৃক্ততা।

গত ১৩ই মে অপহৃত রেডিসন হোটেলের কর্মী আলেয়া ফেরদৌসী জলিকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। জলিকে কৌশলে ধর্ষকদের হাতে তুলে দেয়া থেকে তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়া এবং হত্যা পর্যন্ত সহযোগী ছিল কবিতা নামের এক নারী। র‌্যাব ১-এর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কবিতা বর্ণনা করে কিভাবে জলিকে গাড়িতে তুলে নেয় সে। র‌্যাবের কাছে নারী অপরাধী কবিতা স্বীকার করে কেবল জলিকেই নয় গত মে মাসেই সে ফাঁদে ফেলে ধর্ষকদের হাতে তুলে দেয় রাজধানীর আরও ১০ নারীকে। তার মধ্যে হত্যা করা হয় ৪ জনকে। একটি অপরাধী চক্রের হয়ে কাজ করে কবিতা। তিন পুরুষ অপরাধীর একজন তার স্বামী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের তুলে নিয়ে তার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে, ক্রেডিট কার্ড হাতিয়ে নিয়ে ধর্ষণের পর কখনও হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয় সড়কের পাশে। কবিতার অপরাধী চক্রের সদস্য জহির, রাজু ও সাজু। এর মধ্যে রাজু তার স্বামী। রেডিসন হোটেলের কর্মী আলেয়া ফেরদৌসী জলি ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে পিতা-মাতা, ভাইবোনের কথা চিন্তা করে বিয়ে না করে আয়ের টাকায় পিতার সংসার চালাচ্ছিলেন। ওই মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার লাশ মেলে পুবাইলের রাস্তার পাশে। জলিকে কিভাবে ফাঁদে ফেলা হয় র‌্যাবের কাছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিতা জানিয়েছে, শিকার ধরার জন্য একটি কালো গ্লাসের সাদা প্রাইভেট কার নিয়ে বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল তারা। গাড়িতে ছিল জহির, সাজু ও তার স্বামী রাজু আর সে। সে সময় কাওলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখে জলিকে। তারা গাড়িটি নিয়ে জলির পাশে দাঁড়ায়। গ্লাস খুলে কবিতা বলে, আপু আপনি কোথায় যাবেন? জলি বলেন, রেডিসন হোটেলের কথা। কবিতা বলে, আপু আমরা তো ওই দিকেই যাচ্ছি, চাইলে আপনাকে লিফট দিতে পারি। গাড়িতে একজন নারীকে দেখে সাহস করে গাড়িতে ওঠেন জলি। জলি গাড়িতে ওঠামাত্র কয়েক গজ দূরে গিয়ে গাড়ির কালো গ্লাস তুলে দিয়ে দরজা লক করে দেয়া হয়। গাড়িটি ঘুরিয়ে চালানো হয় উত্তরার দিকে। প্রথমে কেড়ে নেয়া হয় জলির কাছে থাকা ২৩ হাজার টাকাসহ ক্রেডিট কার্ড। গাড়ির ভেতরেই জহির, রাজু ও সাজু পালাক্রমে ধর্ষণ করে জলিকে। গাড়িটি পুবাইল এলাকায় নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয় তার লাশ। র‌্যাব-১-এর সদস্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় অপরাধী চক্রের সদস্যদের। ২২শে মে গ্রেপ্তার হওয়ার আগের মাত্র তিন সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০ নারীকে তারা অপহরণ করে একই কায়দায়। ওই নারীদের অপহরণের কথা বলতে গিয়ে কবিতা র‌্যাবকে জানিয়েছে, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে বাসস্ট্যান্ড এলাকাগুলোতে ওত পেতে থাকে তারা। বাস বা সিএনজির জন্য কোন নারীকে অপেক্ষা করতে দেখলেই তার কাছে প্রাইভেট কার থামিয়ে গাড়ির গ্লাস খুলে কবিতা তাকে লিফট দেয়ার কথা বলে। গাড়িতে একজন নারীকে দেখে অনেকেই রাজি হয়ে যায় লিফট নিতে। গাড়িতে উঠলেই তার ভাগ্যে ঘটে অঘটন।
সামপ্রতিক সময়ে রেন্ট-এ কারের গাড়ি ভাড়া নিয়ে সে গাড়ি নিজের বলে বিক্রি করে দেয়া এক নারী অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওই নারী অপরাধীর নাম রিজওয়ানা খালেদ ইমা। বিভিন্ন সময় সে রেন্ট-এ কার থেকে মাসিক চুক্তিতে গাড়ি ভাড়া নিয়ে পরে জাল কাগজ তৈরি করে তা বিক্রি করে দিয়েছে। আবার একই গাড়ি বিক্রি করার কথা বলে বায়নার টাকা নিয়েছে একাধিক লোকের কাছ থেকে। রিজওয়ানা খালেদ ইমা একটি জিপ গাড়ি মাসে ৭৫ হাজার টাকার চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছিল। প্রথম দু’-এক মাস ভাড়ার টাকা দিয়ে পরে জাল কাগজ তৈরি করে গাড়ি বিক্রি করে দেয় আবার ওই গাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণা করে নাট্যনির্মাতা দীপঙ্কর সেনগুপ্তের সঙ্গে। গাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল জোয়ার সাহারা এলাকার আমির হোসেনের কাছ থেকে। দীপঙ্কর সেনগুপ্তের কাছে বিক্রির জন্য কথা হয় ৯ লাখ টাকায়। তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে প্রতারণা করে তার সঙ্গে। এ নারী প্রতারক সম্পর্কে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার অভিযোগ আছে।
গত এপ্রিল মাসে মিরপুর এলাকায় র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে এক নারী। নিজেকে প্রবাসী পাত্রী পরিচয় দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে যুবকদের বিয়ের জালে ফেলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয় সে। একজন প্রতারিত যুবকের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফরিদা নামের ওই যুবতী বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ৬ মাসে ১৫ যুবককে বিয়ে করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ৫-৭ লাখ টাকা। গত মাসে এক তরুণী অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে ২০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে মহাজোটের এক এমপির। ওই এমপির বনানীর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে একটি চাকরির প্রার্থনা করতে এসে খাতির জমিয়ে তার পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয় ওই তরুণী। শেষ পর্যন্ত ২০ লাখ টাকা খেসারত দিয়ে ইজ্জত বাঁচিয়েছেন ওই এমপি।
অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে যুবকদের পাচার করার একটি প্রতারক চক্র বাংলাদেশে আসে লিবিয়াতে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পরপর। কয়েক মাস তারা অবস্থান করে বাংলাদেশে বারিধারার অভিজাত হোটেল লেকশোর-এ। দালালের মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নেয় কয়েক কোটি টাকা। ওই সব লিবিয়ান যুবকের অপরাধ কাণ্ডের প্রধান সহযোগী ছিল বাংলাদেশের এক তরুণী। ওই তরুণীসহ গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে লিবিয়ান যুবকদের। সামপ্রতিক সময়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি অপরাধ কাণ্ডে সম্পৃক্ত নারী অপরাধীদের পাকড়াও করা হলেও এখনও অনেক চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
সমপ্রতি নারীদের সব ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, আসলে অপরাধী অপরাধীই, আমাদের চোখে সব অপরাধীই সমান। তবে এটা ঠিক, সমপ্রতি নারী অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, বিষয়টির দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি রয়েছে বলে নারী অপরাধীরাও পার পাচ্ছে না, ধরা পড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.