ভিত্তিপ্রস্তরের রাজনীতি আমাদের বাজেট by কাজী জেসিন

সামনে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম পাথেয় হলো ‘আশাবাদ’। তাই ‘আশাবাদ’ সুন্দর। আর তা যদি হয় জনকল্যাণে তাহলে তা নিঃসন্দেহে আরও সুন্দর।
কিন্তু এবারের বাজেট বক্তৃতার শেষে আমাদের অর্থমন্ত্রী, বাজেটে যে আশা বা স্বপ্নকে ধারণ করা হয়েছে তাকে বললেন ‘অশোভন আশাবাদ’। কুইক রেন্টালের মতোই এ এক আজিব ভাষা ও তরিকা আবিষ্কার। যে আশাবাদ মানুষকে এগিয়ে নেয়ার, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, তা যতই বড় হোক তা কখনই অশোভন, অসুন্দর বা কুৎসিত হতে পারে কি? নিজেই যে খোয়াব থেকে তিনি এ বাজেট পেশ করলেন নিজেই তাকে বললেন অশোভন? ভাববার বিষয়! এ বছর ৫ই এপ্রিল সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা সন্তানদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে ‘সিঙ্গেল মাদার’ বা ‘একাকী মা’ বলে ফেললেন। খুব সম্ভবত তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন বাচ্চাদের দৈনন্দিন লালন পালনের কাজে প্রেসিডেন্ট-স্বামী বিশেষ ধরনের বাস্তব ব্যস্ততার জন্য সময়-সাহায্য করতে পারেন না। ফলে তাকে সিঙ্গেল মাদারের মতই এককভাবে সব সামলাতে হয়। সিঙ্গেল মাদারদের সঙ্গে মিশেল ওবামার মিলের জায়গা এতটুকুতেই। তার কথার এই অব্যক্ত কিন্তু সুপ্ত থাকা অর্থের (ইমপ্লায়েড) দিকে নজর না দিয়ে বরং তিনি ফার্স্ট লেডি বলে সবাই তার উচ্চারিত কথাকে ভুল অর্থের দিক নিয়ে তোলপাড় শুরু করলেন। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে স্বামী-প্রেসিডেন্টের ব্যস্ততার কথা উল্লেখ করলেন। তবুও এ বক্তব্য বিস্তর সমালোচনার জন্ম দিলো, বেশির ভাগ মানুষই একে আখ্যা দিলো ‘ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ’ বলে। সমালোচকরা প্রশ্ন তুললেন ‘একজন স্ত্রী কি করে একসঙ্গে বসবাসরত তার জ্বলজ্যান্ত স্বামীর কথা ভুলে যান? তার ভেতরে একাকী মা’র অনুভূতি না কাজ করলে কি করে তিনি নিজেকে ‘সিঙ্গেল মাদার’ বা “একাকী মা” বলে ফেলেন?’ - টেনে লম্বা করা বাড়াবাড়ি ব্যাখ্যা সন্দেহ নাই।
তবু মনস্তত্ত্বের এই আলোচনার মধ্যে যদি আমরা ঢুকি তবে দেখি, মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আমি দেখিয়েছি এই ফেনামেনা [ভুল শব্দে বলা কথা] কোন দুর্ঘটনা নয়। একই ভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও এই মনস্তত্ত্ব পর্যালোচনা ব্যবহার করা যেতে পারে। লাভ হতে পারে অসংখ্য ছোটখাটো মুখ ফসকে বলা কথা এবং ভুল থেকে যাকে বলা হয় সিমটমিক কার্যকলাপ। আমি দেখিয়েছি এই ফেনামেনান শরীরবিদ্যার চেয়ে অনেক বেশি গবেষণার দাবি রাখে। যা অর্থবহুল এবং যার ব্যাখ্যা হতে পারে, এবং যাকে বলা যায় অবদমিত আকাঙক্ষা ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ (অটোবায়োগ্রাফি অব সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ১৯২৫)। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যালোচনার করা যেতে পারে। ‘অশোভন আশাবাদ’ যদি আমাদের অর্থমন্ত্রীর ‘ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ’ না হয়ে থাকে, যদি তিনি তা ভেবেচিন্তে জাতিকে জানিয়ে থাকেন তবুও এ শব্দযুগলের এহেন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কি বার্তা তিনি আমাদের দিতে চান তা বোঝা প্রয়োজন। বোঝা দরকার দেশকে এগিয়ে নিতে প্রণীত আশাবাদের দলিলকে কেন তিনি অশোভন বললেন। এবারের বাজেটের উদাহরণ সৃষ্টিকারী বিশাল ঘাটতি নিয়ে ইতিমধ্যে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা, অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা আমরা শুনেছি। কোন তাত্ত্বিক পর্যালোচনা বা অর্থনীতির পরিসংখ্যানে ডুব না দিয়ে যদি দেখি এবারের বাজেট আমাদের কি দিয়েছে তাহলে দেখা যায় মূলত দুনীতিগ্রস্ত কালো টাকার মালিক ছাড়া এবারের বাজেট কাউকেই খুশি করতে পারবে না। নির্বাচনী বাজেট বলে মানুষ আশা করেছিল এই বাজেট দেশের জনসাধারণকে খুশি করার একটি বাজেট হবে। এ বাজেটে এমন কোন দিকনির্দেশনা থাকবে যা দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করবে, দ্রব্যমূল্য কমাতে ভূমিকা রাখবে, ভোটারদের একটি বড় অংশ, দেশের কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু না, সে গুড়েবালি। সদ্য-গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় নি। তাসত্ত্বেও একদিকে যেমন আবার এবারেও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রার রাজস্বের ওপর নির্ভরশীলতা স্বপ্ন বোনা হয়েছে, তেমনি এর ওপর আবার বিশাল ঘাটতি মেটাতে বাইরের অর্থবাজার অর্থাৎ ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। যেখানে দেশে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে সেখানে বাজেটের বিশাল ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের ওপর অতি নির্ভরশীলতা সেই পরিবেশকে আরও স্থবির করবে সন্দেহ নেই। ধনী-গরিবের জন্য একই রাজস্বনীতি (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) এটা পরিবর্তন না করে উল্টো রাজস্ব আদায়ের আওতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের মনে হতাশা জাগিয়েছে। দেশের মানুষ সরকারকে কর দেয় রাষ্ট্রকে দক্ষ ও সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে, নানবিধ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রকল্প কাজের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কারণ এভাবেই দেশের মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি অবকাঠমোগত সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্র জনসাধারণের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে থাকে। যদিও সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানো যায় না। সিটের অভাবে বারান্দায় রোগী পড়ে থাকার দৃশ্য নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি স্কুলে শিক্ষার মান নিয়ে দীর্ঘদিনের সমালোচনার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে শিশু মনকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার নানা কৌশল। এর সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় খুলনার সাবেক মেয়রের সঙ্গে হযরত উমরকে তুলনা করে প্রশ্নপত্র তৈরি (সূত্র: আরটিটিএন, ১৪.০৬.২০১৩)।
হাইওয়ে সড়কগুলো অব্যবস্থাপনায়, নির্মাণ মেরামত সঠিক সময়ে না করায় সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অস্ত্রের মুখে টেন্ডার ছিনতাইয়ের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা তো আমাদের বলেই দেয় জনগণের করের টাকা কোথায় যায়। যেখানে প্রতিটি সরকারি সংস্থায় দলীয় যোগ্যতায় নিয়োগ একটি ওপেন সিক্রেট, খুন-রাহাজানির দেশে পুলিশ যখন ব্যস্ত থাকে বিরোধী নেতাদের নিয়ন্ত্রণে, নিজের ঘরে মৃত্যুর পর যখন আমাদের মন্ত্রীরা বলেন ‘মবেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়’ তখন মানুষের কর পরিশোধের আকাঙক্ষা নিদারুণভাবে কমে যাওয়ারই কথা। সেই সঙ্গে সরকারের কর আদায়ের নৈতিকতা। বছরের পর বছর ধনী-দরিদ্র সবার কাছ থেকে সরকার ক্রমবর্ধমানহারে কর আদায় করছে বিনিময়ে সাধারণ মানুষ পেয়েছে শুধুই বাহারি প্রতিশ্রুতি। এবারের বাজেটে বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতিময় কাগজের ফুলের মধ্যে একটি লক্ষণীয় নতুন বিষয় হলো সরকারের ইমেজ রক্ষা করতে জনগণের খেসারত ও এর নতুন কায়দা।
যে কোন বাজেটে সাধারণত বিনিয়োগের রেট অব রিটার্নকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কোন খাতে রেট অব রিটার্ন যদি কম আসে বা অনিশ্চিত জায়গায় থাকে তবে অন্য অ-অর্থনৈতিক যেমন আর্থ-সামাজিক ন্যায্যতার দিক জোরদার থাকতে হয়। কিন্তু তারও যদি বালাই না থাকে, যদি খোলাখুলি ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ উদ্ধারের ব্যাপার থাকে তাহলে তাকে অগ্রহণযোগ্য বললে কম বলা হয়। যদিও এমনিতেই অর্থঘটিত বিষয়ে রিটার্ন অনিশ্চিত হলে তাকে বেকুবি বিনিয়োগ বলা হয়। অথচ এবারের বাজেটে সাধারণভাবে কৃষিতে মোট বরাদ্দ আগের তুলনায় কম এবং ভর্তুকিখাতে ৫শ’ কোটি কমানো হয়েছে, আর বিপরীতে একটি অনিশ্চিত খাত পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের আরও অন্যান্য অনেক অপ্রতিষ্ঠিত যুক্তিতে বরাদ্দের পাশাপাশি এ দু’টি সিদ্ধান্ত সরকারের মনোজগৎ বুঝতে আমাদের খুব সাহায্য করবে। আমরা এ দু’টোর একটা তুলনা করবো। মনে রাখা দরকার কৃষিতে বিনিয়োগের রিটার্ন আসে খুব অল্প সময়ে, তিন থেকে চার মাসে। তাছাড়া সরকার এমন সময়ে কৃষিতে ভতুর্কি কমিয়েছে যখন কৃষিতে প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে ২.৭ শতাংশে। উল্লেখ্য, ২০১১-১২ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.১১, চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ২.১৭ শতাংশে, এর আগে ২০১০-২০১১ তে ছিল ৫.১৩ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে শস্য ও শাক সবজি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি, চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। শুধু কৃষি নয়, প্রতিটি খাতে ভর্তূকি বণ্টনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ একটি চিরায়ত গল্পে পরিণত হয়েছে। মাঝারি মানের ও প্রান্তিক কৃষকরা যেখানে ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সেখানে আমাদের ডিজিটাল সরকার ভর্তুকি বণ্টনে কোন আধুনিক বা ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ না করে ভর্তুকিই কমিয়ে দিয়েছে! দফায় দফায় ইউরিয়া, বীজ, কীটনাশক, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে উৎপাদন খরচ যখন প্রায় দ্বিগুণ, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক যখন হতাশ তখন এ বাজেট কৃষকের মাঝে আশার সঞ্চার করবে এমন আশা থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। এর আগে কৃষকের হতাশা আমরা দেখেছি, দেখেছি কিভাবে কৃষক নিজের রক্ত ঘাম করা ফসল পথে ফেলে চলে গেছে। ন্যায্য দাম না পেয়ে নিজের হাতে আবাদ করা শস্য পথে ফেলে যে কৃষক চলে গেছে তার খবর আমরা কি রেখেছি? নিজেদের কৃষকবান্ধব দাবি করা দল ক্ষমতায় বসে কৃষকদের জন্য যে ভালবাসা দেখিয়েছে তা হয়তো কৃষকদের কাছে তামাশার মতোই লাগে। সরকারি নেতাদের মুখে আমি বলতে শুনেছি, ‘আপনারা একদিকে ধান-চালের ন্যায্যমূল্যের কথা বলবেন আবার অন্যদিকে চালের দাম বাড়লে সরকারের সমালোচনা করবেন’- এ জাতীয় কথা। এর অর্থ কি এ নয় যে বর্তমান সরকার কোন সামগ্রিক সমন্বিত স্ট্র্যাটেজিক প্লান ছাড়াই চালের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল? পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানোর এবং একই সঙ্গে শহরের শ্রমিক ন্যূনতম কতমূল্যে খাবার সংগ্রহ করবে এ দুইয়ের মধ্যে একটা প্রবল ভারসাম্য রাখার কোন পরিকল্পনা কি সরকারের ছিল না? নাকি কৃষকের কথা না ভেবেই [কেবল ভোকাল শহুরে মধ্যবিত্তকে পক্ষে নেয়ার লোভে] বর্তমান সরকার ২০ (মতান্তরে ১০) টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল? জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি সরকারকে অবশ্যই রাখতে হবে, নইলে এমন ফাঁকা প্রতিশ্রুতি সরকারকেই খেয়ে ফেলবে। পাশাপাশি কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থাও সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকার, কূল বা শ্যাম কোন দিকই রক্ষা করতে না পেরে, সরকার চালানোকে খেলাপাতি খেলা বানিয়ে ফেলেছে। একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ায় কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য পায়নি অন্যদিকে সাধারণ মানুষও ১০ বা ২০ টাকা কেজি চাল পায়নি। গত চার বছর ধরে এ দুর্দশা চলার পর এবার আরও দুর্যোগের তথ্য হলো বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ এবার কম রাখা হলো।
যদিও যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে না কোনদিন তাও ‘শৈল্পিক গুণে’ অনেক সময় আমাদের মন জয় করে। কথার ফুলঝুরিতে আমরা ভুলে যাই। কিন্তু এবারের বাজেটে পদ্মা সেতু নির্মাণে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে যেমন নেই ‘শৈল্পিক গুণ’, তেমনি নেই কোন অর্থনৈতিক বিবেচনার গুণাবলী। ৬.১৫ কি.মি. দৈর্ঘ্যেরে পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা; সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি। বর্তমান সরকার দেশের মানুষকে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ সেতু নির্মাণের প্রস্ততি পর্বের শেষ এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ফাঁস করে দিলো সরকারের দুর্নীতির তথ্য। একদিকে যখন বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করছে সরকারের মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতিতে জড়িত, তারা দুর্নীতির আলাপ, কমিশন ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রফায় পৌছেছিলেন [আইনি ভাষায় যাকে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করার অপরাধ’ বলা হয়]। অন্যদিকে, সরকার জনগণকে বোকা ভেবে বারবারই মুখরক্ষার জবাবে বলছে, যেখানে অর্থই ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতি হবে কোথা থেকে।
অথচ ইতিমধ্যে মানুষ জেনে গেছে সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে কাকে কত শতাংশ ঘুষ দেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে আমরা এমনকি ‘দেশপ্রেমিক’ সার্টিফিকেট দিতে শুনেছি। আরও অনেকের সঙ্গে ২% ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও আদালতে মামলা শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া সচিবকে আবারও আদালত জামিন দিয়েছে যুক্তিকে স্বপদে ফিরিয়ে আনতে দেখেছি। অনেকেই হয়তো বলবেন, এসবই প্রমাণ করে সংবিধান লঙ্ঘন করে কেন ও কাদের অর্থের হেফাজত করতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাজ পেতে এসএনসি-লাভালিনের ১০% ঘুষের রফা ও এর ভাগবাটোয়ারা বিতরণের হিসেব জেনে যখন মানুষের চোখ ছানাবড়া তখন দুর্নীতি ঢাকতে সরকারের নতুন পদক্ষেপ হলো পদ্মা সেতুর জন্য বাজেট বরাদ্দ।
একে তো পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে জনগণ বিপর্যস্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু সরকারের দিক থেকে সমস্যার অনুভব সেটা নিয়ে নয়। তার সমস্যা অনুভব নিজ দলের ইমেজ, কারণ সামনে আবার জনগণের মুখোমুখি হয়ে তাকে ভোট চাইতে যেতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের নিজের কৃতকর্মের জন্য ইমেজ কি হবে তার দায় কোনভাবেই জনগণের নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রক্ষা করতে জনগণকে আবার অত্যাচার সহ্য করতে হবে, বাজেটে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতু নির্মাণের ৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে অথচ বাকি বৃহৎ অংশের অর্থ আসবে কোথা থেকে তা এখনও নিশ্চিত না। আদৌ কি সেতু হবে? আমরা অনিশ্চিত। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত এ অর্থের রেট অব রিটার্ন শূন্য। এটা ছোটখাটো বা এক-আধটা অনিশ্চিত নয়। যেমন: এক. নিজ অর্থনৈতিক সক্ষমতা স্টাডি, যাচাই এবং তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে আমরা নিজ বৈদেশিক অর্থে সেতু করার সিদ্ধান্ত নিইনি। সেতু নির্মাণে বাজেটে বরাদ্দ রাখার এ সিদ্ধান্ত পলিটিক্যাল এবং স্টান্টবাজি। আগামী নির্বাচনের আগে জনগণকে দেখানো, বুঝ দেয়া; ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রক্ষা এটাই সিদ্ধান্তের ভিত্তি। ফলে সেতু বানানো সরকারের আসল লক্ষ্য না। লক্ষ্য হলো, ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রিপেয়ারের চেষ্টা। দুই. বৈদেশিক মুদ্রার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বিষয়টা রাষ্ট্রের বিদেশী মুদ্রা আয়-ব্যয় যে হিসাব আছে মসে খাতার বরাদ্দ কুলানো এবং সফল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। তা সত্ত্বেও দেশী মুদ্রার বাজেটে শোরগোল তোলা হচ্ছে। তিন. নিজের টাকায় সেতু কথাটা শুনতে দেশপ্রেমে বুক ফুলে উঠলেও প্রশ্নটা সস্তা দেশপ্রেমের না, সক্ষমতার। প্রশ্ন হলো আমাদের অর্থনীতির অতিরিক্ত তৎপরতা হিসেবে আমরা তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের যোগ্য কিনা? বিদেশী বাজারে আমাদের প্রতি সে আস্থা আছে কিনা? তা কতটুকু? সেসবের পরীক্ষা আমরা এখনও দিইনি। আমরা সেতু করতে চাই শুনে তা বিশ্বাস করে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে কি উপযুক্ত ও যথেষ্ট সংখ্যক কোম্পানি আসবে? আমরা এখনও এর কিছুই জানি না। বরং, তারা জেনে যাবে যে এটা নিজ সক্ষমতা যাচাই করে নয় বরং ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রক্ষা এটাই আমাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এর ফলে টেন্ডার আহ্বান ও তাতে উপযুক্ত কোম্পানিগুলোর সাড়া দেয়া কি আদৌ ঘটবে? যদি না ঘটে এ অনিশ্চয়তায়- তাহলে বাজেটে বরাদ্দ থাকা অর্থ রাখা অর্থহীন। শুধু তাই নয়, আমরা এই অর্থ কেটে এনেছি কৃষিসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাতকে বঞ্চিত করে।
সার কথায়, যে অর্থ বরাদ্দ রেখে কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো যেতো সেই অর্থ এখন ব্যয় হবে সরকারের দুর্নীতি ঢাকতে, ইমেজ মেরামত করতে। কৃষির মতো চার মাসের স্বল্প সময়ের বিনিয়োগ রিটার্ন ফেলে আমরা অনিশ্চিত সেতু নির্মাণের জন্য অনিশ্চিত বিনিয়োগ রিটার্নের জন্য সে অর্থ ফেলে রাখতে চাইছি।
এমনিতেই যখন প্রতিবছর আমাদের পরিশোধ করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ, নিজ চোরামি স্বভাবের গুণে তখন বিশ্বব্যংকের স্বল্পসুদের ঋণের এই সুযোগ হাতছাড়া করার অর্থ হলো, জনগণের ওপর আরও বড় অঙ্কের সুদের ভার চাপানো। কারণ এ বাস্তবতা দেশের সকল মানুষও জানে যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কত অসম্ভব। একথা আজ পরিষ্কার, বাজেট বরাদ্দ প্রমাণ করেছে দেশের স্বার্থের চেয়ে আমাদের সরকারের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রক্ষা। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন এখন দূরপরাহত তবু জনগণকে প্রয়োজনীয় কৃষিসহ ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত করে বাজেটে এ বরাদ্দ রাখা হলো সরকারের শরীর থেকে দুর্নীতির কালো দাগের তীব্রতা কমাতে। প্রত্যাশার শূন্য ঝুড়ি হাতে জনগণ হয়তো মনে মনে জপছে ‘(সেতু) ভিক্ষা চাইনে মা, তোর কুকুর ঠেকা’। কারণ আমরা বুঝে গেছি ভিত্তিপ্রস্তরের রাজনীতি। যে বাজেট নিজেদের কালিমা ঢাকার বাজেট, যে বাজেটের মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন নয়, তা কখনই শোভনীয় হতে পারে না, তাই হয়তো আমাদের অর্থমন্ত্রী স্বগভোক্তিতে বাজেট নামক এ আশাবাদের দলিলকে বলেছেন, ‘অশোভন আশাবাদ’। অবশ্যই এটা অশোভন। এবং অন্যায়।
তবে আশাবাদ যেমনই হোক প্রতিশ্রুতির আলেয়ার পেছনে মানুষ বেশি দিন ছোটে না। রাতের আঁধার যখন ভার হয়ে চেপে বসে তখন সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই খুঁজে নেয় প্রতিশ্রুত সকাল। খুঁজে নেয়, কারণ গ্রিক লেখক ইউরিপিডিস-এর সে উক্তি আমাদেরও মগজে খেলা করে,, ‘When one with honeyed words but evil mind persuades the mob, great woes befall the state.’

No comments

Powered by Blogger.