দিনটি গোজ্জাপোয্যা আর সাংগ্রাই আপ্যাইংয়ের by সাইদ আরমান ও মাজেদুল নয়ন

এ বাড়ি, ও বাড়ি, ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা, বন্ধুদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড়- এ রীতিতেই পাহাড়ে পালিত হয় গোজ্জাপোয্যা।  গোজ্জাপোয্যা মানে অলস সময় কাটানো। আর নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে এভাবেই বরণ করে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী চাকমা ও ত্রিপুরা।
অন্যদিকে মারমাদের জন্যে উৎসবটি সাংগ্রাইয়ের বিদায় ‘সাংগ্রাই আপ্যাইং’।
Beju
দিনটি মারমাদের কাছে নতুন বছরের শুরু বলে ধারণা করা হয়। এদিনেও পুষ্পপূজা, দোইংতা (আহার দান) করা হয়। বিহারে আসা পুণ্যর্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় পিঠা। গ্রামে গ্রামে প্রতিবেশীদের মধ্যে পিঠা বিনিময় করা হয়। একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে পড়ে পিঠা খাওয়ার ধুম। এদিন গ্রামে বয়োজ্যেষ্ঠদেরও পিঠা দান করা হয়।
মারমা সম্প্রদায় উদযাপন করে ঐতিহ্যবাহী পানিখেলা উত্সব। এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে বৈসাবি।

চৈত্র সংক্রান্তির শেষ দু’দিন ও বাংলা নবর্ষের প্রথম দিন মূলত বিজু উৎসব উদযাপন করে চাকমা সম্প্রদায়। নতুন বছরের আগের দিন মূল বিজু এবং বছরের প্রথম দিন গজ্জাপোয্যা উদযাপন করে তারা। একই সময়ে হয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসব।
চাকমারা একে ‘বিজু’, মারমারা `সাংগ্রাই` ও ত্রিপুরারা `বৈসু` নামে যুগ যুগ ধরে পালন করছে। এ তিন উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়। বাঙালিরাও এ উৎসবে শামিল হন নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে। 
Bejuএদিকে আদিবাসীদের প্রধান এ সামাজিক উত্সবকে উপলক্ষে জেলা শহরসহ সব হাট-বাজারের গার্মেন্টস ও কাপড়ের দোকান, কাঁচা তরি-তরকারি ও মুদির দোকানে গতকালও শত শত আদিবাসীদের কেনা-কাটার ভিড়ে উত্সবে ভেসেছে রাঙামাটি।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয়েছে মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব।
এদিকে, বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত এলাকায়ও উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে পাড়া মহল্লায় শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা।
বাংলা নববর্ষ ও বৈসাবির বর্ণাঢ্য উৎসবে পাহাড়ে যেন বেজে চলেছে জাতিগত সম্প্রীতির সুর। শুক্রবার পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুর বৈসাবির মূল আনুষ্ঠানিকতা।
পরদিন অতিথিদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাঁচন’ পরিবেশন আর একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব তার চিরায়ত ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করে। বৈসাবি উৎসবের রেশ ধরে আজ উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ।

Bejuবৈসাবি পাহাড়ে যেন নিয়ে আসে নববর্ষের বাড়তি অনুষঙ্গ। কারণ এখানে বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা প্রায় এক সপ্তাহ আগে শুরু হয়। যার রেশ থেকে যায় নববর্ষের পরও। তাই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে এ উৎসব সৃষ্টি করে বাড়তি উন্মাদনা।
রেবাবার ১৪২০ সাল। নতুন বছরকে বরণ করতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন আয়োজন করেছে বিভিন্ন কর্মসূচির। সকালে শহরের পৌর প্রাঙ্গণ থেকে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস শুক্কুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলছে বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া বিকেলে গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বলিখেলা রিজার্ভ বাজার শহীদ আব্দুস শুক্কুর স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হবে।

এর আগে শুক্রবার চাকমা জনগোষ্ঠীর ছিল ‘ফুল বিজু’ ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ছিল ‘হাঁড়িবসু’ উৎসব। এছাড়া পাহাড়ি অন্য জনগোষ্ঠীর জনগণও পানিতে ফুল ভাসায় এদিন। শুক্রবার সকালে রাজবনবিহারের পূর্ব ঘাটে ফুল বিজু উৎসবে কর্ণফুলী নদীতে ফুল ভাসায় চাকমা যুবতীরা।

পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাই যেনো ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালালেন পাহাড়ের মানুষ।

উৎসবের কয়েকটা দিন সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে কাটায় পাহাড়ের মানুষ। এছাড়া অতিথিদের মধ্যে বৈসাবির ঐতিহ্যবাহী খাবার পাঁচন পরিবেশন করা হয়। বহু প্রকার সবজি দিয়ে তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী এ পাঁচন। পাহাড়িদের বিশ্বাস, এই পাঁচন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এছাড়া একদিনে সাত পরিবারে এই পাঁচন খেলে সর্বরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বিজুর দিনে পাহাড়িদের বাসায় পাহাড়ি-বাঙালি সবাই যায়। এদিন ফুটে ওঠে অসম্প্রদায়িক মনোভাব।

No comments

Powered by Blogger.