কুষ্টিয়ায় পুলিশ হেফাজতে কাঠ ব্যবসায়ীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানায় পুলিশ হেফাজতে তাইজাল  মল্লিক (৪৫) নামে এক কাঠ ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে আটকের পর রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানা থেকে তাইজালকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে রাত ১২টা ৫ মিনিটে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশরাফুল ইসলাম অঞ্জন জানান, তাইজালকে হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই সে মারা যায়। অপরদিকে পুলিশের দাবি, আটকের পর সে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়ার পথে সে মারা যায়।

পুলিশি হেফাজতে মৃত তাইজালের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী দাবি করেছে, কোন মামলা না থাকলেও শুধুমাত্র একটি শিশু গাছ কেনার অপরাধে পুলিশ তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তাকে আটক করার আগে ওই শিশু গাছ বিক্রেতা সাবদার খানকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে সাবদার খানকে ছেড়ে দিয়ে এলাকার চিহিৃত পুলিশের সোর্স পূর্ব আব্দালপুরের খালেক ফকিরের ছেলে শাহীনকে দিয়ে একটি কাঠের লগ (গুঁড়ি) উঠিয়ে নিয়ে যান ইবি থানার ওসি। পরে তিনি শাহীনকে দিয়ে নিহত তাইজালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খেকে বাকি কাঠ বিক্রি করে দেন। এ নিয়ে শুক্রবার বিকালে হরিনারায়ণপুর বাজারের বীণা শাহ্‌র গুড়ের আড়তে একটি সালিশ বৈঠক হয় এবং সেখানে শাহীন দোষী  প্রমাণিত হয়। তখন ওই গাছ সরকারি সম্পত্তি নয় এবং সেটি মালিকানাধীন গাছ বলেও ইবি থানা পুলিশ ঘোষণা দেয়। অথচ সেই গাছ ক্রয়ের অপরাধেই তাইজাল মল্লিকের মৃত্যু হল। এলাকাবাসী আরও অভিযোগ করেছে এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ স্থানীয়দের নিকট থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে।
পুলিশি হেফাজতে নিহত তাইজালের নিকটাত্মীয় প্রত্যক্ষদর্শী সদর উপজেলার হাতিয়া আব্দালপুর চরপাড়ার কৃষক মন্টু খান অভিযোগে দাবি করেছেন, পুলিশ তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, একজন নিরীহ কাঠ ব্যবসায়ী তাইজালকে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ইবি থানার হরিনারায়ণপুর ক্যাম্পের আইসি এসআই শরিফুল ধরে নিয়ে যান, এ সংবাদ পাওয়ার পর ওই ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাইজালকে ইবি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় থানার বারান্দার নিচে তাইজালের মৃতদেহ পড়ে আছে। মাত্র দুই/আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কিভাবে তার মৃত্যু হলো এর জবাব একমাত্র পুলিশই দিতে পারবে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত হলেই প্রকৃত রহস্য পাওয়া যাবে।
নিহত তাইজাল মল্লিকের বড় ভাই আবদুল আজিজ মল্লিক অভিযোগ করেন, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ইবি থানার হরিনারায়ণপুর পুলিশ ক্যাম্পের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরীফুল ইসলাম হরিনারায়ণপুর বাজার থেকে একটি মীমাংসিত গাছ কাটার ঘটনায় তাইজালকে ধরে নিয়ে যায়। হরিনারায়ণপুর ক্যাম্পে নেয়ার পর তাকে প্রহার করে পুলিশ। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানায়। সেখানেও তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হলে তার মৃত্যু ঘটে বলে দাবি করে তিনি বলেন, গাছ বিক্রেতাকে না ধরে আমার ভাইকে ধরে মেরে ফেললো পুলিশ। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।
তবে মৃতের পরিবারে সদস্যদের অভিযোগ অস্বীকার করে ইবি থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী রুহুল ইমাম জানান, তাকে একটি গাছ চুরি মামলায় আটকের পর থানায় নিয়ে এলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ মামলার বাদী কে এবং মামলা কত তারিখে এন্ট্রি হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি থানার বাইরে আছি। ব্যাপারটা সিনিয়ররা তদন্ত করছেন। আর সোর্সের ব্যাপার ও সালিশের ঘটনা সত্য নয়।
সূত্র জানায়, যে গাছ কেনার জন্য তাইজালকে আটক করা হয়েছিল সেটি সরকারি গাছ নয়। সূত্র আরও জানায়, যে শিশু গাছটি তাইজাল কিনেছিল সেটির মালিক স্থানীয় সাবদার খান। ১৬ হাজার টাকায় গাছটি সে কিনেছিল। পুলিশ গাছটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের দাবি করলেও তাদের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ থানায় দেয়া হয়নি। ইবি থানার ওসি গাজী রুহুল আমিন নিজেই গাছ কাটার অভিযোগে ইবি থানায় একটি জিডি করেছেন। রাত ১০টার দিকে এসআই শরিফুল তাইজালের বাড়িতে ফোন দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা জানায়। ইবি থানার আরেকটি সুত্রে জানায়, নিহত তাইজালের নামে থানায় কোন জিডি বা মামলা নেই এবং এ ঘটনায় কোন মামলা ছিল না। পরে ব্যাক ডেটে ইবি থানার ওসি কাজী রুহুল ইমাম এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
আব্দালপুর এলাকার শাহজাহান খান বলেন, একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাইজাল মল্লিকের লাশের সুরতহাল করা হয়। তারপরও কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রেজা সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে নিয়েছে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রেজা বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তাদের উপস্থিতি সুরতহাল রিপোর্ট লেখা হয়। একটি গাছ চুরি সংক্রান্ত অভিযোগে তাইজাল আলীকে পুলিশ আটকের পর ইবি থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু ঘটে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে গতকাল দুপুরে ময়না তদন্ত শেষে আবাসিক চিকিৎসক ডা. অরবিন্দু পাল বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কার্ডিয়াক অ্যাটাকে মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে হলে ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। পুরুষাঙ্গে শুক্রাণু এবং মলদ্বারে মল থাকার ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে তাইজাল নিহতের ঘটনায় উত্থাপিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে ইবি থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী রুহুল ইমাম জানান, তাকে একটি গাছ চুরি মামলায় গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসার পর ডিউটি অফিসারের রুমেই সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তাকে কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি।
উল্লেখ্য, সুরতহাল রিপোর্টে লেখা হয়েছে উল্লেখযোগ্য বাহ্যিক কোন আঘাত দেখা যায়নি। তবে পুরুষাঙ্গে শুক্রাণু এবং মলদ্বারে মল ছিল। আবার নিহতের ময়না তদন্তের সময় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ইবি থানার কোন কর্মকর্তা ছিলেন না। সেখানে একজন দারোগা থাকার কথা সেখানে কুষ্টিয়া মডেল তানার ওসি সিকদার মশিউর রহমান দায়িত্ব পালন করেন। নিহত তাইজাল কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আব্দালপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের মৃত বদর মল্লিকের ছেলে। দু’পুত্রের জনক তাইজাল আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.