প্রাপ্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরকে বরণ

গ্লানি মুছে প্রাপ্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরকে বরণ করলো জাতি। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের রঙিন উৎসবে রোববার মেতেছিল দেশ। সব শ্রেণী-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষ একাকার হয়ে উদযাপন করেছেন বাংলা নববর্ষ। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ছিল বর্ষবরণের আমেজ।
উচ্চারিত হয়েছে সকল অশুভকে পরাভূত করার স্লোগান।

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে রবির কিরণ ছড়ানোর আগেই ঢাকা মহা নগরীতে নেমে আসে লাখো মানুষের ঢল। প্রতিার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বেহালা-বাঁশি-এস্রাজের ‘রাগ ললিত’ এর সুরে ভাঙ্গে ভোরের স্তব্ধতা, আর কোরাসে মুখরিত হয়ে ওঠে ভোরের বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে শুরু হয় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ ; ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে...’ প্রভৃতি গানে।
এরপর দিনভর বাদ্যযন্ত্রে নগরী মেতে ওঠে বর্ষবরণের বাঙময় উৎসবে। বাঙালী হারিয়ে যায় কবিতায় ও সুরের সাগরে। ভোর থেকে শুরু হওয়া এ উৎসব চলে রাত পর্যন্ত, আর লাখো মানুষের ঢল পরিণত হয় মহামিলন মেলায়।
বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলামোটর থেকে রূপসী বাংলা হয়ে রমনা, পল্টনÑপ্রেসকাব থেকে মৎস ভবন হয়ে রমনা, পুরান ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে রমনা এবং ধানমন্ডি থেকে কাঁটাবন হয়ে রমনায় ঢোকার সকল পথেই যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
দিনের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছায়ানট ভোর সোয়া ছ’টায় সুর্যের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ‘রাগ ললিত’ সুরে ভোরের স্তব্ধতা ভেঙ্গে বর্ষকে বরণ করে নেয়। বেহালা-বাঁশি-এস্রাজ নিয়ে এ সুর পরিবেশন করেন শিল্পী আলমাস আলী, মো. মনিরুজ্জামান ও অসিত বিশ্বাস। এরপর সমবেত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা শোনান কবিগুরুর গান ‘আলো যে ওই যায় রে দেখা ওরে আলো...’।
একক কণ্ঠে শিল্পী ইলোরা আহমেদ শুকা গেয়ে শোনান রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠলো বেজে যেই...’। সেঁজুতি বড়ুয়ার কণ্ঠে ‘তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে তারে বাঁধনে রাখিবি বাঁধি...’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটি পরিবিশিত হয়। পরে খায়রুল আনাম শাকিল শোনান নজরুল সঙ্গীত ‘ভোরের হাওয়া এলে ঘুম ভাঙাতে কী...’।
এরপর শুরু হয় প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি। একে একে পরিবেশিত হয় সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’, শামসুর রাহমানের ‘দুখিনী বর্ণমালা’, হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’, নবারুণ ভট্টাচার্য্যের ‘এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না’ এবং কবি জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’।
এ পরিবেশনায় ছায়ানটের শিশু ও তরুণÑতরুণী শিার্থী এবং শিক মিলে প্রায় দেড়’শ শিল্পী ছিলেন মঞ্চে।
ছায়ারটের বর্ষবরণের এ আয়োজনে আসতে সবাইকে পেরুতে হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। এক যুগ আগে ২০০১ সালে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর প্রতি বছরই নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে রমনায়। নিরাপত্তা বহরে এবার রাখা হয় হেলিকপ্টারও।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলার শিার্থীরা বর্ষবরণ উপলে সকাল পৌনে দশটায় বের করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও চারুকলার পঁচিশতম শোভাযাত্রা হওয়ায় এবারের ¯োগান দেয়া হয়েছে ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’।
বর্ষবরণের সার্বজনীন এ উৎসবের নানা আয়োজনের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এ বর্ণিল আয়োজনটি রঙে-ঢঙে পায় ভিন্ন এক মাত্রা।
ঢাক-ঢোল, খঞ্জনিসহ নানা বাদ্য-বাজনার মুখরতায় ২৪ জন ঢাকি শোভাযাত্রার সূচনা করেন। এর পরপরই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে তোলা নানা অনুষঙ্গ নিয়ে শুরু হয় শোভাযাত্রা। এর মূল অনুষঙ্গ ছিল নয়টি শিল্প-কাঠামো, হরেক রকমের মুখোশ, টাট্টু ঘোড়া ও বর্ণিল প্ল্যাকার্ড।
জাতীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মঙ্গল শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরে শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বের হয়ে শাহবাগ মোড় পেরিয়ে রূপসী বাংলা ঘুরে টিএসসি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের সাম্প্রতিক অপতৎরতা শোভাযাত্রার অনুষঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এ েেত্র অশুভ প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে ৬০-৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে বিশাল সরীসৃপ। দুই পা-ওয়ালা ভয়ঙ্কর এ সরীসৃপের হা করা আগ্রাসী মুখটিও এক পরিচিত রাজাকারের।
তিনি জানান, জয়নুলের আঁকা সেই তেজী ষাঁড়ের আদলে একটি বিদ্রোহী ষাঁড়ে শিল্প-কাঠামোও এবার শোভাযাত্রায় ছিল। রাষ্ট্র, সমাজের সব ধরনের অন্যায়-অবিচারসহ যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার জনতার প্রতিবাদকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ শিল্পকর্মটির মাধ্যমে। ১৪ ফুট উচ্চতা ও ১২ ফুট দৈর্ঘ্যরে কাঠামোয় গড়ে তোলা হয়েছে শিল্পকর্মটি।
তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে শোভাযাত্রায় ছিল শান্তির পায়রা। সকল ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ঘুচিয়ে সমন্বিত সমাজ গঠনের প্রকাশ ছিল এই শিল্প-কাঠামোয়।
সদ্য প্রয়াত চারুকলার শিল্পী ও শিক মরণ চাঁদ পালের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোভাযাত্রায় স্থাপন করা হয় তার রিকশা মোটিভের শিল্প-কাঠামো। হাতির পিঠে যুদ্ধাংদেহী শীর্ষক শিল্প-কাঠামোয় ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে তরুণ প্রজন্মের এক যোদ্ধার লড়াইয়ের দীপ্ত প্রত্যয়।
বর্ষবরণ উপলে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করেছে হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে শুরু হয় এ অনুষ্ঠান। সবার জন্য উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে অংশ নেন দেশের নবীনÑপ্রবীণ হাজারও কণ্ঠশিল্পী। তারা গান করেন একক ও সম্মিলিত কণ্ঠে। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্ববধানে ছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় এক শোভাযাত্রা বের করে মহানগর আওয়ামী লীগ। বাঙালীর চিরায়ত ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরা হয় নববর্ষের এ শোভাযাত্রায়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোট ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আয়োজন করে একক ও দলীয় লোকসঙ্গীত এবং নৃত্যানুষ্ঠানের। বাংলা একাডেমী সকাল সাড়ে ৭টায় একাডেমীর নজরুল মঞ্চে বর্ষবরণ সংগীতের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করে।

No comments

Powered by Blogger.