কনগ্র্যাচুলেশন >> ড. মুহাম্মদ ইউনূস

২০০৬ সাল। ২০১৩ সাল। একুশ  শতকের দু’টো সালই বিশ্বজুড়ে আলোচনায়। সাদা কথায় রাজনীতির নেতিবাচক খবরে বাংলাদেশ শিরোনাম হচ্ছে মিডিয়ায়। চলছে দেশ ও দেশের বাইরে নানা দৌড়ঝাঁপ। দেশের গণতন্ত্রও যায় যায়। প্রবৃদ্ধি নামছে অবিরত। লগি-বৈঠার প্রতিযোগিতা চলছে সবখানে।
হচ্ছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। তখন নীরবে একজনই বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। একাত্তরে দেশ হয়েছে। নব্বইয়ে গণতন্ত্র এসেছে। রজতজয়ন্তী হয়েছে। সুবর্ণ জয়ন্তীতে পৌঁছবে দেশ। হয়তো শতকের পর শতক। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নানা প্রতিকূলতায় বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়। ড. ইউনূস মাথা নোয়াবার নয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য জয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল জোবরা গ্রাম থেকে। তারপর ইতিহাসের পাতা উল্টালেই চোখে পড়বে সংগ্রামের পর সংগ্রাম। বাধা-বিপত্তি জয় করে চলেছেন। থামেননি। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ আজ  যাকে নিয়ে গৌরব করে- বিশ্ব আজ যার নামে বাংলাদেশকে চেনে। অথচ কতভাবেই এ মানুষটি নাকাল হয়েছেন; সমালোচনায় কাল কাটাতে হয়েছে সরকারের। যে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. ইউনূসকে নিয়ে গেছে আকাশসম উচ্চতায়। অথচ নিজভূমে তাকেই দৌড়াতে হয়েছে আদালতের চৌহদ্দিতে। বয়সের ধুয়া তুলে আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে তাকেই। বিনয় ভব্যতায়, হাসিমুখে সকল অপবাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। অকাট্যভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের স্বার্থে বিশ্ব দরবারে। কোটি নারীমুখে হাসি ফুটিয়ে শান্তির আহ্বান ছড়িয়ে দিয়েছেন দুনিয়াজুড়ে। ৮৫৬ টাকা দিয়ে শুরু যে প্রতিষ্ঠানের তা আজ দেশে দেশে অনুকরণীয়। ইউনূস প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতি পৃথিবীর বহু দেশে দারিদ্র্য জয়ের স্বীকৃত মাধ্যম। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ২০ কোটি মানুষ এ পদ্ধতি দারিদ্র্য জয়ের সুফল ভোগ করছে। ২০০৬ সালের ১৩ই অক্টোবরের আগে আমাদের ছিল একাত্তর। আর সেদিন যুক্ত হয়েছিল শান্তিতে ড. ইউনূসের নোবেল জয়। ২০১৩ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ যখন রাজনীতির কালবোশেখিতে ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। কি হবে তার ইয়ত্তা নেই। দেশ কোন পথে তার নিশানা জানা নেই কারও। জনমনে শঙ্কা আবারও কি দেশ সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হবে। দেশজুড়ে চলছে সংঘাত আর সংঘর্ষ। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকার পাতাজুড়ে। সমস্যার আবর্তে দেশ। ঠিক তখনই ড. ইউনূসের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল আমাদের গৌরবের আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়েই দেখা দেয়। বিশ্ব আকাশে আমরাও পারি- সেই বার্তাই পৌঁছে দেন তিনি। রাজনৈতিক হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ আর দ্বিধাবিভক্তির রাজনীতি যখন সারা বিশ্বে দেশের ইমেজ সঙ্কটের কারণ তখন নতুন পরিচয়ে বাংলাদেশকে উঁচিয়ে ধরলেন নোবেল জয়ী ড. ইউনূস। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকে ভূষিত করা হলো ড. ইউনূসকে। যিনি বিশ্বব্যাপী একাই লড়ছেন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে। বুধবার গরিবের ব্যাংকারকে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলে দু’দলের আইন প্রণেতারা সংবর্ধনা দিলেন। পরিয়ে দিলেন সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানের খেতাব। গোল্ড মেডেলে দু’টো দৃশ্য উৎকীর্ণ করা হয়েছে। একপাশে ড. ইউনূসের হাসোজ্জ্বল মুখচ্ছবি। অন্যপাশে বাংলায় লেখা ‘আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবো’। এ পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস নরম্যান বারলগ, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইলি উইসেল, অং সান সু চি ও মাদার তেরেসার কাতারে চলে গেছেন। এ ৬ ব্যক্তিও নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাশীল এ দু’টি পুরস্কার পেয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, তিনিই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পেলেন।
আবেগ আপ্লুত ড. ইউনূস পুরস্কার প্রাপ্তির মুহূর্তে ভোলেননি দেশ মাটি ও মানুষকে। নোবেল জয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, এ অর্জন দেশের মানুষের মাথা উঁচু করবে। আমার স্বপ্ন হলো বাংলাদেশ যেন এমন একটি দেশ হয়- যেখানে একজন লোকও গরিব থাকবে না। কথা রেখেছিলেন ড. ইউনূস। শত বাধাতেও দমেননি। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে ছুটে চলেছেন। উদ্ভাবনী সম্ভাবনা নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন নতুন কার্যক্রমের সূচনা করেছেন। সামাজিক ব্যবসা তাকে নতুন আলোচনায় নিয়ে গেছে বিশ্ব দরবারে। দুনিয়ার তাবৎ স্বীকৃতি এ মানুষটির ঝুলিতে; তার দিকে বিশ্ব তাকিয়ে রয়। বিশ্ব পরাশক্তির নেতৃত্বদানকারী আইনপ্রণেতাদের তিনি তার স্বপ্ন ও বাংলাদেশের গল্প শুনিয়ে চলেছেন আগের মতোই।
পুরস্কার গ্রহণ করে যৌথ অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় ড. ইউনূস বলেন, আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত আমার বন্ধু কংগ্রেস সদস্যরা আমার সম্পর্কে এতক্ষণ ধরে যা বলেছেন, তা শুনে আমি চোখে পানি ধরে রাখতে পারছি না। আমার  কান্না পাচ্ছে। মিডল টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় আমি প্রথম ক্যাপিটলে এসেছিলাম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য প্রথম ওয়াশিংটন এসেছিলাম।
বাংলাদেশের নোবেলজয়ী ‘অভূতপূর্ব সম্মাননা’ দেয়ার জন্য কংগ্রেসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ সম্মাননা তার ক্ষুদ্রঋণের স্বীকৃতি। তিনি বলেন, ‘আমি এ সম্মাননা কেবল আমার জন্য নয়, বরং যেসব নারী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আপনাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা দেয়া হলে তারা স্বনির্ভর হতে পারেন তাঁদের হয়ে গ্রহণ করছি।
প্রজ্ঞা মেধা আর সততাকে পুঁজি করে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক বয়ে এনেছে একের পর এক অসামান্য অর্জন। দুনিয়াজুড়ে সেরা স্বীকৃতির তালিকায় যদি ১০০টির নাম বলা হয় তার প্রায় সব ক’টিই এসেছে ড. ইউনূসের কাছে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৪ সালে ফিলিপাইন থেকে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৯ সালে সুইজারল্যান্ড থেকে আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর এগ্রিকালচার, ১৯৯৩ সালে ফেয়ার হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৪ সালে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ, ১১৯৬ সালে ইউনেস্কোর সাইমন বলিভার প্রাইজ, ১৯৯৮ সালে প্রিন্স অব অ্যাস্টুরিয়ান অ্যাওয়ার্ড, ২০০৪ সালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ইকনোমিস্ট অ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ সালে ভারতের মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ড, সিউল পিস প্রাইজ, ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডল অব ফ্রিডম।
সকল স্বীকৃতির বর্ণনা এক প্রতিবেদনে দেয়া সম্ভব নয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল অকুতোভয় এই মানুষটি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন গৌরবের শীর্ষে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অমর্ত্য সেন বাঙালিকে নোবেল পুরস্কার এনে ইতিহাস গড়েছেন। কিন্তু ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে ইউনূস একজনই। নোবেল জয় শেষে দেশে ফিরে তিনি শান্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। গণতন্ত্র রক্ষায় একযোগে এক কাতারে সকলকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই উদারতা দেখাতে পারেনি আমাদের বিবদমান কোন পক্ষই। অন্য সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুুর মতোই দ্বিধা ছিল। ছিল সংকীর্ণতাও। যা কিছু ভাল; যা কিছু আমাদের অর্জন। তা কেন নয় সকলের। তাকে সম্মান জানাতে আমাদের এত দ্বিধা কেন? বিশ্বসভায় যিনি শ্রেষ্ঠ আসনে সে মানুষকে নিয়ে আমাদের এই ক্ষুদ্রতা কেন? সকল শ্রেণী-পেশা-মত নির্বিশেষে এ অর্জনকে আমরা কি উচ্ছ্বাস ভরে গৌরবমাল্যে বরণ করতে পারি না।
ড. ইউনূসকে খালেদার অভিনন্দন
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকে ভূষিত হওয়ায় বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়া। এক অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃতী সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল প্রদানে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। এই বিরল সম্মাননা অর্জনের মাধ্যমে তিনি দেশ ও জাতিকে আবারও বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করলেন। বেগম জিয়া বলেন, এর আগেও তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ও মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মান, পদক ও পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। খালেদা জিয়া তার অভিনন্দন বার্তায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং সামাজিক বাণিজ্য উদ্ভাবনার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ড. ইউনূসের অসামান্য ভূমিকার কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বকে মানুষের কল্যাণে বাস্তবে রূপায়ণের মাধ্যমে তিনি যখন একের পর এক আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করছেন সেই মুহূর্তে স্বদেশে সরকারিভাবে তাকে নানা রকম হেয়প্রতিপন্ন করার প্রয়াস আমাদেরকে ব্যথিত করে। এতে বিদেশে আমাদের ভাবমর্যাদাও অনেক ক্ষুণ্ন হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আশা প্রকাশ করেন, ড. ইউনূস এই সম্মাননা লাভের মাধ্যমে দেশ ও জনগণের কল্যাণে অবদান রাখতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। জনগণের সমর্থনে আগামীতে দেশসেবার সুযোগ পেলে তিনি উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে ড. ইউনূসের প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে জনগণের স্বার্থে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধি ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিবেন। বাংলাদেশের একজন কৃতী নাগরিককে এই বিরল সম্মানে ভূষিত করার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, জনগণ, সরকার ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.