মহাপুণ্য কুম্ভমেলা by প্রিয়ব্রত ব্রহ্মচারী মহাতীর্থ

ভারতের প্রয়াগরাজে কুম্ভযোগ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি মহাপুণ্য লগ্ন। মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত ও স্কন্দপুরাণাদিতে কুম্ভযোগের সূত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃহত্তম এই কুম্ভমেলা।
সম্রাট হর্ষবর্ধনের শাসনামলে (৬২৯ -৬৪৫) চৈনিক পর্যটক হিউ ইন সাঙয়ের (৬০২-৬৬৪) ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে প্রথম লিখিত কুম্ভমেলার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, কত শতাব্দী ধরে এই মেলা চলে আসছে তা তিনি বলতে পারবেন না। তবে নদীতীরে অসংখ্য হিন্দু নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অবগাহন ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য ধারা হিসেবে প্রবহমান আছে।
এ বছর কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের উত্তর প্রদেশে এলাহাবাদ শহরের অদূরে প্রয়াগরাজে ত্রিবেণী সঙ্গমে। কলিযুগে গঙ্গাস্নানেই তীর্থ ফলপ্রদ_ এ কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। প্রয়াগরাজে হিমালয় থেকে গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী_ এই তিন পবিত্র নদী প্রয়াগরাজে মিলিত হয়েছে। এজন্য ত্রিবেণী সঙ্গম বা সঙ্গম নামে পরিচিত। ১৪১৯ বাংলা বছরে কুম্ভযুগ বা শাহি স্নান মকরসংক্রান্তি, মৌনী অমাবস্যা, বসন্ত পঞ্চমী, মাঘী পূর্ণিমা ও ভীম একাদশী তিথিতে শাহি স্নান মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হবে। উলি্লখিত শাহি স্নানে লাখ লাখ সাধ-সন্ন্যাসীর সমাগম হয়।
গত কুম্ভমেলায় সর্বসাকল্যে হরিদ্বারে সরকারি হিসাবে ৭ কোটি ২০ লাখ পুণ্যার্থী সমাগত হয়। কুম্ভমেলা বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। প্রয়াগরাজ একান্ন পিঠের এক পিঠ। প্রয়াগরাজের কাছের তীর্থস্থানগুলো বানারসী, সারনাথ, দেবী মন্দির বিন্ধ্যাচল, সীতা সমাহিত, চিত্রকুট অযোধ্যা গোরক্ষপুর, গয়া ও বু্দ্ধগয়া।
এ বছরের পূর্ণ কুম্ভ প্রয়াগরাজে শাহিস্নানের নির্ঘণ্ট উল্লেখ করা হলো। এবার ১ম শাহি স্নান মকরসংক্রান্তি ১৪ জানুয়ারি, দ্বিতীয় শাহি স্নান পৌষ পূর্ণিমা ২৭ জানুয়ারি, ৩য় স্নান মৌনী অমাবস্যা ১০ ফেব্রুয়ারি, ৪র্থ স্নান বসন্ত পঞ্চমী ১৫ ফেব্রুয়ারি, পঞ্চম শাহি স্নান মাঘী পূর্ণিমা ২৫ ফেব্রুয়ারি। তাছাড়া একাদশী স্নান ৬ ফেব্রুয়ারি, রথ সপ্তমী ভূমি একাদশী স্নান ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
অনাদিকাল থেকে মানুষের অন্তরের গভীরে রয়েছে অমৃতের জন্য এক বুকজোড়া হাহাকার। এই ত্রিপাপদগ্ধ, মায়াময় মরু-সংসারের আবর্তে পড়ে জীব কেবলই আসে আর যায়, দুঃখ-জ্বালা ও পাপ-তাপে ক্লিষ্ট হয়, আধিব্যাধিতে ভোগে, জরায় জীর্ণ হয়, মৃত্যুতে শ্মশানে যায়। পার্থিব ভোগ-সম্পদের প্রাচুর্য তাকে প্রকৃত সুখ-শান্তি তো দিতে পারেই না, অধিকন্তু এনে দেয় প্রতিক্রিয়াজনিত অশেষ দুঃখ ও অশান্তি। সে বারে বারে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। এই যে দুঃখ, এই যে তাপ, এই যে অশান্তি, এই যে মৃত্যু, এ থেকে কি মুক্তির কোনো পথ নেই? কোথায় অমৃত? মানবই আত্মা, ব্রহ্ম এবং মানব নিজেই এক অমৃতকুম্ভ। ভারতের কুম্ভযোগ, ভারতের তীর্থ মানুষকে এনে দেয় এক অধ্যাত্ম অন্তশ্চেতনা। এটাই কুম্ভস্নান ও তীর্থপরিসেবনের অমৃতময় ফলশ্রুতি। যদি এই আত্মচেতনার জাগরণ না ঘটে তবে বুঝতে হবে পূজার্চনা, যাগযজ্ঞ, তীর্থস্থান, দেবদর্শন সবই গতানুগতিক মাত্র।এটা হস্তিস্নানের ন্যায় সাময়িক বিলাস, এতে স্থায়ী ফল কিছুই হয় না। প্রাচীন বৈদিক ঋষি সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে 'অমৃতের সন্তান'রূপে আহ্বান করে বার্তা জানিয়েছেন পরমপুরুষ বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্ব সম্বন্ধে। আরও জানিয়েছেন, প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আত্মারূপে জীবে ব্যাপ্ত ব্রহ্মই সত্য। তাকে না জানা পর্যন্ত মুক্তিলাভের আর কোনো উপায় নেই। দশ হাজার বছর আগে ভারতীয় সনাতনধর্মীরা বিশ্ববাসীকে দিয়েছেন সর্বপ্রথম শাশ্বত ধর্ম, প্রার্থনা, সমাজ কাঠামো ও দর্শন।
'সর্বে সুখিনা ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক_ সকলে নিরাময় হোক।'

মহামণ্ডলেশ্বর প্রিয়ব্রত ব্রহ্মচারী মহাতীর্থ : বাংলাদেশ সন্ত মহামণ্ডলের মহামণ্ডলেশ্বর, সভাপতি ওয়ার্ল্ড হিন্দু ফেডারেশন (ধর্ম সংসদ), বাংলাদেশ santmahamandal@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.