কথা সামান্যই-সমাজবিজ্ঞানে গবেষণার সীমারেখা by ফজলুল আলম

ধরে নিন, মতামত জরিপের উদ্দেশ্যে আপনাকে দুটি প্রশ্ন করা হলো- এক, যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপ আপনাকে বেশি প্রভাবান্বিত করে কি? দুই, নাকি সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণায় আপনি উদ্বেলিত? আমার বর্তমান জরিপ মতে দেখা গেছে যে ৭৩.৫ শতাংশ বলেছেন 'যুক্তরাষ্ট্র', ১৭.৬ শতাংশ সমাজতন্ত্র, ৮.৯ শতাংশ উত্তর দেননি।
অথচ ৩০ বছর আগে এই একই রকম দুই প্রশ্নের ভিত্তিতে জরিপের ফল ছিল, ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা সমাজতন্ত্র নিয়ে উদ্বেলিত, মাত্র ২০ শতাংশ 'যুক্তরাষ্ট্র', বাকি ১২ শতাংশ বলেছেন- জানি না বা উত্তর নেই। এই তথ্য থেকে আমাদের একটা চমৎকার সামাজিক মনস্তত্ত্ব উদ্ঘাটিত হচ্ছে নাকি?
এই যে সুন্দর একটা জরিপ থেকে আপনি ও অনেকে যে সামাজিক তথ্য পেলেন, তা সত্যি মনে হচ্ছে নাকি? আসলে আমি এখন বা ৩০ বছর আগে এমন কোনো জরিপ করিইনি। পুরোটাই বানানো। ফলে এই জরিপের ফল অর্থহীন। তাহলে এখানে বলে রাখা যায় যে বেশির ভাগ সামাজিক জরিপের ফলই অর্থহীন। কারণ কিন্তু গবেষকদের গাফিলতি নয়- কারণ হচ্ছে যে হ্যাঁ বা না বলা কোনো জরিপের কার্যক্রম কখনোই সত্য নির্ধারণ করতে সক্ষম নয়! এই যে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে (কোশ্চেনেয়ার মেথড) প্রশ্ন করা, অথবা প্রশ্নপত্র ছাড়া (কোয়ালিটেটিভ মেথডে) আলোচনার মাধ্যমে কোনো বিষয়ে উত্তর বের করা, সেসব উত্তরই সব সময় 'সত্যি' হয় না। পিতামাতার সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার থাকতে হবে কি, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সবাই 'হ্যাঁ' বলবে। কারণ, নারীবিদ্বেষী মনোভাব জনসমক্ষে স্বীকার করে না কেউ।
যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপ আপনাকে বেশি প্রভাবান্বিত করে, এটা স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে আপনি উঠতে-বসতে আমেরিকার নাম জপ করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সব কার্যকলাপে আপনি-আমি কেউই খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারি না, আবার এই দেশটাকে আমাদের জীবন থেকে ফেলেও দিতে পারি না। দেশটা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, এটা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না। আমেরিকার অনেক কর্মকাণ্ড, বিশেষত বৈদেশিক সম্পর্ক ও যুদ্ধবিগ্রহের গতিপ্রকৃতির ক্ষেত্রে আমেরিকা সবার প্রিয় দেশ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেনি। না করলেও রাজনৈতিকভাবে ব্রিটিশদের নানা কারণে মার্কিনিদের ওপর এতই নির্ভর করতে হয় যে ইরাকযুদ্ধে দলীয় সমর্থন না থাকলেও লেবার পার্টির সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণ সহায়তা দিতে বাধ্য হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কত না কত মানবিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য অবস্থান নিয়েছে। তারা কত না অপকর্ম করেছে, যুদ্ধবাজ জাতি হিসেবে তারা সুপরিচিত। কোরিয়া ও ভিয়েতনামে তারা কী করেছে, সেসব তো এখনো জাজ্বল্যমান ইতিহাস। এমনকি নিজ দেশে হিসপানিক ও কৃষ্ণকায় ব্যক্তিদের অবস্থান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অতি করুণ রয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে; নিউ ইয়র্কের যে গেটোতে এদের সংখ্যা বেশি, সেখানে নবজাত শিশুমৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি (অনেকে বলে, তৃতীয় বিশ্বের শিশুমৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি)। বেকারের সংখ্যা তো বেড়েই চলছে।
কিন্তু তার পরও বিজ্ঞানে, গবেষণায়, দর্শনে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায় বিশ্বমানবতার কাছে তাদের অবদান তো কম নয়! বিশ্বজুড়ে স্থায়ী অভিবাসনে যুক্তরাষ্ট্রই (অস্ট্রেলিয়া নয়, কানাডা নয়, ব্রিটেন তো নয়ই- ইউরোপ তো এ বিষয়ে প্রায় অস্তিত্বহীন) অভিবাসীদের প্রথম পছন্দের দেশ। এ থেকে মনে হয়, আমার মিথ্যা জরিপের ফল সম্ভবত ঠিকই আছে। হলিউডের সিনেমায় এবং বর্তমানে আমেরিকার টিভি সিরিয়ালে বর্ণবাদ দেখাই যায় না, কৃষ্ণ ব্যক্তিরা হিরো-হিরোইন হয়, গানে সর্বোচ্চ সম্মান ও যশ পায়, অফিসের বস হয়- কত কী? এমনকি সেখানের মিডিয়ায় চীনা-কোরিয়ান-ভিয়েতনামিদের পর্যন্ত দেখা যায়।
তাহলে মার্কিন দেশ সম্পর্কে এই মিথ্যা জরিপ যদি ঠিক হয়ে থাকে, সমাজতন্ত্র সম্পর্কেও আমার মিথ্যা জরিপ ভুল হবে না। একটা সময় ছিল, যখন সমাজতন্ত্রের বাণী আমাদের আলোড়িত করত খুব বেশি। শুধু আমাদের কেন, বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদ একটা নতুন পৃথিবী সৃষ্টিতে অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। এই সাধারণ জ্ঞান থেকে আমি যে মিথ্যা জরিপের ফল দেখিয়েছি, তা অনেকেই মেনে নেবেন। সমাজবিজ্ঞানে অবশ্য এ ধরনের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ কম, নেই বললেই চলে। কিন্তু কেন? সহজ সত্যটি হলো, সমাজবিজ্ঞানে সমাজতন্ত্রের নানা তত্ত্ব অবহেলা করা যায় না এবং কিছু কিছু মার্কসীয় বিশ্লেষণ সেখানে করা হয়। তবে সেসব অধিকাংশ সময় নেতিবাচক হয়ে ওঠে। দারিদ্র্যের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়ে অসম সম্পদ বণ্টনের কারণ প্রদর্শন করতে মার্কসীয় শ্রেণীবিভাজন অবশ্যই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সমাজবিজ্ঞান যখন এই দুটি মার্কসীয় ক্ষেত্র (উৎপাদনব্যবস্থা ও শ্রেণীবিভাজন) বর্জন বা পরিত্যাগ করে, তখন সেখানে শিক্ষণীয় কিছু থাকতে পারে কি? অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমাজবিজ্ঞানে পার্থক্য দেখিয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি করা আর জ্ঞানের জগতে বৈষম্য সৃষ্টি করা একই হয়ে ওঠে।
সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি (কৃতিত্ব : এমিল দুর্কহেইম ১৮৫৮- ১৯১৭) আবিষ্কার করার সময়টা ছিল ইউরোপের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবিস্তারকারী দেশগুলোর জন্য একটি ভীতত্রস্ত সময়; মার্কসের মতে, ইউরোপে কমিউনিজম নামে 'এ স্পেকটার ইজ রাইজিং'। সমাজবিজ্ঞান একটা পুরোপুরি ধনবাদ সমার্থক পাঠ্যক্রম হিসেবে হাজির হলো, আমরা যতই অন্য রকম ভাবি না কেন।
কে প্রমাণ করবে যে পৃথিবীতে সাম্যবাদের আগমন ঠেকাতে সমাজবিজ্ঞানই পুরোভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছে কি না?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.