বসে থাকি প্রবালের সিংহাসনে by এনামুল হক

হে আমার দেশ তুমিত জানই প্রাগৈতিহাসিক দায়বদ্ধতার চেতনায় সমর্পিত আমার সমসত্ম ভালোবাসা।
তোমার জন্য যে তীব্র আকুলতা আর উন্মাদনা আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে
তা কখনও কোন সসত্মা প্রশংসার দাবিদার নয়
আমার সত্তার অনত্মর্গত দেশ মাটি এবং মানুষের সঙ্গে
আমি সর্বদা দেশজ এবং আত্মার সম্পর্ক অনুভব করি।
আমার অনেক ঋণ কিন্তু সে ঋণ আমি পরিশোধ করব না
জননীর ঋণ শোধ করার প্রচেষ্টা একটা ধৃষ্টতা বৈকি!
ঐ ঋণেই আমি সর্বত্র স্বীকৃত সম্মানিত বিত্তবান।
আমার শৈশব আমার মনের মণিকোঠায় স্থাপিত
আর ভবিষ্যত অবশ্যই তিমির হননে ধাবমান
শৈশবের প্রথম যে স্মৃতি, কৈশোরের প্রথম যে প্রণয়-আকাঙ্ৰা
আমাকে যৌবন-অভিমুখী করে তুলেছিল
একমাত্র তোমার নিখাদ ভালোবাসা তার জন্য দায়ী।
তোমার কাছেই শেখা এবং সেই ভালোবাসা আত্মস্থ করেই
ধীরে ধীরে চিনে ওঠা জন্মভূমিকে আমার হৃদয়ে স্থাপন করলাম।
সেই উপলব্ধি আমার শাশ্বত সংবিধানের লিপিবদ্ধ হয়ে গেল।
কেননা আমার স্বপ্নের ভেতরে আকাশ বাতাস পাখি নদী সমুদ্র অরণ্য
সব কিছু দেহজ অথবা আত্মিক সম্পর্কে সংস্থাপিত।

প্রায় নাম গোত্রহীন, যে মানুষটির গৃহে
জীবনের প্রথম সূর্যকে আমি মোকাবিলা করি
সেই তীর্থস্থান ছিল আমার দৈনিক অসত্মিত্বের কেন্দ্রবিন্দু
তাই আমি কখনো দুর্যোগে পথভ্রষ্ট হইনি অথবা
আমাদের নিজস্ব তুষার-মৌলি পর্বত অথবা
বিশাল বিশাল হ্রদ দখলে না থাকলেও
বিষণ্নতা গ্রাস করতে পারেনি কখনো আমাকে।

নিষ্ঠুর কুটিল কত শক্তি শাসক শোষক আমাকে নিশ্চিহ্ন/
করতে চেয়েছে /সবাই হয়েছে সে চেষ্টায় ব্যর্থ
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ৰয়ে যাওয়া দ্বীপের মত এখনো রয়েছি আমি
সারি সারি নারিকেল বৃৰের ছায়ায় বসে থাকি প্রবালের সিংহাসনে।

তোমার সংস্পর্শে এসে আমি জীবনকে চিত্রিত করেছি বহুরূপে
মেহেদী পাতার মত আমার বাইরে সবটা সবুজ
তাই আমি সবুজের অভিমুখী
অথচ ভেতরে গাঢ় প্রচ- বাসনত্মী অমলিন।
আমিত কখনও ভুলতে পারিনি পূর্ব প্রজন্মের রক্তমাখা ইতিহাস,
একটানা সবুজ ধানের খেত, বড় বড় নদী,
পাখিদের বর্ণালী স্বপি্নল ডানা,
হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়া শিলাবৃষ্টি,
ডালিম গাছের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস,
এদের সঙ্গেই ছিল আমার মোহন অনিবার্য গোপন সম্প্রীতি
এই কলাপাতা-রঙ অনুভূতিগুলো আমাকে প্রকৃতি ও প্রেমের/
প্রগাঢ় জারকরসে উজ্জীবিত রাখে।

আমার সঞ্চিত সব জোনাকীর আলো তোমার জন্যই
কী বসনত্মে কী বর্ষায় পত্র পুষ্পে পলস্নবে তোমার অলৌকিক উপস্থিতি
ভয়ঙ্কর অন্ধকার রাত্রির আত্মায় তোমার বিচিত্র বিচরণ
শস্যৰেত্রে অনত্মরীৰে নিঃসঙ্গ সমুদ্র-প্রেমিক নদীতে বহমান তুমি
আমার সকল মহার্ঘ ইচ্ছার সঞ্চালক অবশ্যই তুমি
তেমনি আমার সকল প্রার্থনা ও প্রাপ্তির চিরস্থায়ী যবনিকা তুমি।

আমার দেহের আলো থেকে দাহ এবং দাহ থেকে আলোর যে পরিক্রমা
সে আলোই আমাকে জ্বালাচ্ছে শুদ্ধতম ভালোবাসা দিয়ে
আমার কিছুই পোড়েনা বরঞ্চ
আমি অনুভব করি আমার একানত্ম অতলানত্ম আত্মার গভীরে
পুষ্পসত্মবক শোভিত সম্ভাষিত শব্দের অনন্য এক মহাসমাবেশ।

একটা শুদ্ধতা আমার সত্তাকে ঘিরে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে
কার সাধ্য আবিলতা দিয়ে আমাকে কলুষিত করে?
আমার নিজস্ব কলেস্নালিত শব্দ-স্রোতস্বি্বনী এতদিন নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল
ভূমিকম্পে সৃষ্ট দূর সমুদ্রের কোনো সুনামি-তাড়িত ঢেউ এসে
নাকাড়া বাজিয়ে হঠাৎ আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে।

আমি আত্মমগ্ন থেকে আত্মধ্বংসী হয়েছি অনেকবার তবে জীবনবিমুখ হইনি কখনো
আজকাল আমি ধিতস্থ সুস্মিত নিম্নকণ্ঠী এবং বিলম্বিতলীয় কোন মরম্নময় নিসর্গচিত্রের/
প্রতি আমার কোনই আকর্ষণ নেই
আমি বস্তুত নির্লিপ্ততম কবি
অহেতুক শব্দ সত্তার রহস্য উদঘাটনে হইচই করিনি কখনও
তবে পৈতৃক নৈপুণ্য বিনিয়োগ করে অনায়াসে
অনেক স্ফটিকস্বচ্ছ শাণিত শব্দের শরীরে শরীরে
প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার পরিয়েছি আমি ॥

No comments

Powered by Blogger.