রাষ্ট্রীয় নির্যাতনবিরোধী আইনের প্রস্তাবে জরুরি বিষয়াশয় by মোহাম্মদ আরজু

দেশে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন রোধে সংসদে প্রথমবারের মতো ওঠানো একটি আইনের প্রস্তাবের (বিল) বয়স তিন বছর পেরিয়ে গেছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। এর আগে স্পিকার কর্তৃক যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানোর দুই বছর পর গত বছরের ১০ মার্চ সংসদের বেসরকারি সদস্য দিবসে উত্থাপিত কমিটির চতুর্থ প্রতিবেদনে ওই  প্রস্তাবটি পাসের সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি।

নবম জাতীয় সংসদের ১২তম অধিবেশন শেষ হলো সম্প্রতি। একজন বেসরকারি সদস্যের আনা এই প্রস্তাবটিকে আইনে রুপ দেবার পথে কোনো অগ্রগতি ছিল না এ অধিবেশনেও।

জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদ ১৯৮৪’র অন্তভুক্ত রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনবিরোধী আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে সংসদে একটা আইন তৈরির প্রস্তাব ওঠান সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। আইনের প্রস্তাবটির সংক্ষিপ্ত শিরোনাম হচ্ছে, ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০০৯’।

সবার আগে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী এই প্রস্তাব আনায় আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। জনাব চৌধুরী যিনি এই আইনটি প্রস্তাব করেছেন- তিনি এক-এগারো পরবর্তী সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সংসদের বেসরকারি সদস্য (মন্ত্রী নন) হিসেবে তিনি এ আইনের প্রস্তাবটি এনেছেন।

আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এই প্রস্তাবিত আইনটার যে অনুলিপি গত জুলাইয়ে সংশ্লিষ্ট নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে- সংশোধন সুপারিশ পাওয়ার লক্ষ্যে- সেই বাংলা সংস্করণটা আমাদের কাছে আছে। সংসদের জন্য প্রস্তুতকৃত একটা ইংরেজি সংস্করণও আছে। যেহেতু বাংলা সংস্করণটিই পর্ষদ কর্তৃক জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে সুপারিশের জন্য- ফলে, আমরা বাংলাটাকে মান ধরেই কথা বলছি। নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রস্তাবটিতে দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অষ্পষ্টতার জায়গা রয়ে গেছে বেশ কিছু।

নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যদাকর ব্যবহার এবং দণ্ড নজর এড়িয়ে গেছে
নির্যাতনবিরোধী সনদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই প্রস্তাবটার নজর এড়িয়ে গেছে। নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর ব্যবহার এবং দণ্ড- এসবের কোনো সংজ্ঞা আলাদাভাবে দেয়া হয় নাই, আইনটার আওতাভুক্ত করা হয় নাই। অথচ বাংলাদেশ শুধু নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘ সনদের অন্তর্ভুক্ত হবার কারণেই নয়, বরং প্রজাতন্ত্রের সংবিধানেও এগুলো নিবারণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে এসব ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাজেই এই নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর ব্যবহারের সংজ্ঞা দেয়া জরুরি এই আইনে। নির্যাতনের যে সংজ্ঞা খসড়ায় দেয়া হয়েছে, তা সংবিধান ও সনদের শর্ত পূরণ করে না।

নির্যাতনের সংজ্ঞা অষ্পষ্ট
প্রস্তাবের ২(৫) উপধারায় নির্যাতনের সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে এভাবে: ‘নির্যাতন’ অর্থ এর ব্যাকরণগত প্রকারান্তরসহ কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন; ক. এতদুদ্দেশ্যে: ১. কোনো ব্যক্তি বা অপর কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য অথবা স্বীকারোক্তি আদায়, ২. সন্দেহভাজন অথবা অপরাধী ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান ও ৩. কোনো ব্যক্তি অথবা তার মাধ্যমে অপর কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো। খ. বৈষম্যের ভিত্তিতে কোনো কর্মসাধন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, কারো, প্ররোচনা বা উস্কানি, কারো সম্মতিক্রমে অথবা নিজ ক্ষমতাবলে কোনো সরকারী কর্মকর্তা অথবা সরকারী ক্ষমতাবলে এরূপ কর্মসাধন।

প্রথম দেখায় মনে হতে পারে  ‘ব্যাকরণগত প্রকারান্তরসহ যুক্ত করে নির্যাতনের সংজ্ঞা ব্যাপক করা হয়েছে। কিন্তু যে সংজ্ঞার আওতায় আদালত কোনো ‘ব্যবহার’কে ‘নির্যাতন’ বলে সাব্যস্ত করবেন, সেটাকে ‘ব্যাকরণগত প্রকারান্তরসহ’ বলে ছেড়ে দিলে পরে, তা আদালতকে এমন এক ধরনের এখতিয়ার দেয় যা অষ্পষ্ট ও অনির্ধারিত। এটা কাজে লাগানো কষ্টকর হবে।

সংজ্ঞার বাকি অংশে জাতিসংঘ সনদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও কিছু মাত্রায় সনদে দেয়া সংজ্ঞার চেয়ে ঠিক উল্টো অর্থ- অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর অর্থ তৈরি হয়েছে। সনদ অনুযায়ী যদি ‘নির্যাতন’-এর একটা মোটামুটি সংজ্ঞা দাড় করাতে হয় তবে তা এরকম হতে পারে:

‘নির্যাতন’ অর্থ হচ্ছে এমন কোনো কাজ যার দ্বারা- ক. কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য অথবা স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দেশ্যে; অথবা খ. কোনো ব্যক্তি বা অপর কোনো ব্যক্তি একটা কাজ করেছে বলে অথবা করেছে বলে সন্দেহ করে সেই ব্যক্তিকে বা অপর কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে; অথবা (গ) কোনো ব্যক্তিকে বা তার মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানোর বা কোনোকিছু করতে জোরপূর্বক বাধ্য করার উদ্দেশ্যে; অথবা (ঘ) যেকোনো ধরনের বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে; অথবা এ ধরনের যেকোনো উদ্দেশ্যে, সেই ব্যক্তি বা অপর কোনো ব্যক্তির ওপর-(ক) শারীরিক; (খ) মানসিকভাবে; তীব্র যন্ত্রনা বা দুর্ভোগ আরোপ করা হয়। শর্ত থাকে যে, নির্যাতন হিসাবে গণ্য হতে হলে এরুপ তীব্র যন্ত্রণা বা দুর্ভোগ অবশ্যই কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকারি ক্ষমতাবলে কর্মরত অন্য কোনো ব্যক্তির (ক) দ্বারা অথবা (খ) উসকানিতে অথবা (গ) সম্মতিতে অথবা (ঘ) প্রশ্র্রয়ে হতে হবে।

এভাবেই মূলত নির্যাতনবিরোধী সনদে নির্যাতনের ‘অর্থ’ দাঁড় করানো হয়েছে। তবে সনদে এভাবে বলা হয় নাই যে, ‘টর্চার মিনস অ্যান্ড ইনক্লুডস’-  বলা হয়েছে ‘টর্চার মিনস’- মানে হলো সনদের বাইরেও চাইলে সংজ্ঞা বিস্তৃত করা যাবে। সেই বিস্তৃতকরণ হয় নাই প্রস্তাবটাতে, বরং সনদে দেয়া সংজ্ঞাকে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকরভাবে হাজির করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা সংস্করণে অনেক ক্ষেত্রে অর্থ উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। মনে রাখতে হবে, এ প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে পরে দেশের অধঃস্তন ফৌজদারি আদালতগুলোর বিচারক ও আইনজীবীদের এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মামলার সুরাহা করতে হবে। যেকোনো আইনি সংজ্ঞার প্রধান অনিবার্য খাসলত হলো স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট থাকা। সেটা আর এখানে থাকল না।

সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা
প্রস্তাবিত আইনের ২(৭) ধারায় ‘ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’র যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তার একটা অংশ স্পষ্ট না। বলা আছে, ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে এই আইনের অধীনে তার ওপর বা তার সংশ্লিষ্ট ও উদ্বিগ্ন এমন কারো ওপর নির্যাতন করা হইয়াছে।’ ‘সংশ্লিষ্ট’ এর ব্যাখা দেয়া হয় নাই। অবশ্য যেহেতু উদ্বিগ্ন বলা হয়েছে ফলে যে কেউ এই ‘উদ্বিগ্ন’ তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে মামলা করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে একইসাথে ‘সংশ্লিষ্ট ও উদ্বিগ্ন’ হবে, না কি স্বংশ্লিষ্ট অথবা উদ্বিগ্নের একটা হলেই চলবে সেটা স্পষ্ট নয়। নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার বা নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার একমাত্র আইনি ক্ষমতা নির্ভর করবে এই সংজ্ঞার ওপর। তাই এখানে অস্পষ্টতা থাকা কাজের কথা নয়।

হেফাজতে মৃত্যুর আওতায় পাবলিক প্লেস নেই
প্রস্তাবিত আইনে হেফাজতে মৃত্যু সংক্রান্ত বিধানের আওতায় হেফাজতে মৃত্যুর স্থান হিসাবে ‘পাবলিক প্লেস’ বা জনপরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকার হেফাজতের গতানুগতিক স্থানের বাইরে আটককৃতের ‘পাবলিক প্লেসে’ মৃত্যুর বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নয়তো ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে মাঝরাতের রাস্তায় বা গলিতে, নদীর পাড় বা মাঠের মতো জনপরিসরে।

ডাক্তারি পরীক্ষা ও স্বাক্ষ্য প্রমাণ প্রসঙ্গে
প্রস্তাবের ৭ ধারা অনুযায়ী কোনো নির্যাতিত ব্যক্তি বিচার কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ আনলে, বিচার কর্মকর্তা সেটা লিখে রাখেবেন এবং রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অভিযোগকারীর দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ  দেবেন। এর থেকে নির্যাতনের সাক্ষ্য-প্রমাণের দলিল বা আলামত সংগ্রহের একটা প্রক্রিয়ার ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু রেজিস্টার্ড অর্থাৎ সরকারি চিকিৎসকের ওপর ডাক্তারি পরীক্ষা পুরোপুরি ছেড়ে দিলে এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। ফলে সরকারি ডাক্তার বা এমন পরীক্ষা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত ডাক্তারের পাশাপাশি অভিযোগকারী কর্তৃক নিযুক্ত ডাক্তারকে দিয়ে যৌথ পরীক্ষার বিধান থাকতে হবে।

অভিযোগ তদন্তের কর্তৃপক্ষ
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের অভিযোগ আসবে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী বা স্বশস্ত্র বাহিনীর কিম্বা কারা কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন নির্বাহী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে আইনের ৯ ধারায় যেভাবে তদন্তের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছে সেটা খুবই অকার্যকর ব্যাপার হবে। এমনতরো তদন্তের আন্তরিকতা, নিরপক্ষেতা ও স্বচ্ছতা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই আইনের যে লক্ষ্য: রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নির্যাতন থেকে নাগরিককে সুরক্ষা দেয়া- এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অবশ্যই বিচার বিভাগীয় তদন্তের বিধান থাকতে হবে।

সংসদে গৃহীত হলে পরে নাগরিক অধিকারের জায়গা থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবতকালে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ আইন হবে এটা। কাজেই চূড়ান্তভাবে আইনের প্রস্তাবটি সংসদের বিবেচনার জন্য পেশ করার আগে এর অষ্পষ্টতা, স্ববিরোধিতা, সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাগুলা ঠিকঠাক করে নেয়া জরুরি। নয়তো সুরক্ষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের খুব একটা কাজে আসবে না এটা। আর আইনে এমন কিছু সমস্যা থাকতেই পারে, যেগুলা কেবল প্রয়োগ করতে শুরু করার পরই টের পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ তো রইলোই।

মোহাম্মদ আরজু: সাংবাদিক ও আইনি বিষয়াদির লেখক।
                          mohammadarju@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.