দখলের ঝুঁকিতে ৪৩ বিঘা জায়গাঃ নদীর ঢাল থেকে ৬০ ফুট ভেতরে হাঁটার পথ! by অরূপ দত্ত

কাঁচপুর থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতীরে সোয়া চার কিলোমিটার দীর্ঘ হাঁটার পথ বা ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণ করা হচ্ছে। আট ফুট প্রশস্ত এই পথ নির্মিত হচ্ছে নদীর ঢাল (ফোরশোর) থেকে প্রায় ৬০ ফুট ভেতরে। অভিযোগ উঠেছে, বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এবং তাঁদের দাবি মেনে এই জায়গা ছাড়া হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঢালের ৬০ ফুট ভেতরে হাঁটার পথ করায় দখলকবলিত এই এলাকায় আরও প্রায় ৪৩ বিঘা জায়গা অবৈধ দখলের ঝুঁকিতে পড়বে। এমনিতেই কাঁচপুরে নদীর তীরে, এমনকি নদীর অংশেও অবৈধভাবে বালু ও পাথরের ব্যবসা চলছে, এখন জায়গা ছাড়ায় এই ব্যবসা স্থায়ী রূপ পাবে। সেখানে অবৈধ স্থাপনা ওঠাও অসম্ভব নয়।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অবশ্য বলেছে, দখল এড়াতে তারা ওই জায়গায় বৃক্ষরোপণ ও তদারক করবে। কিন্তু ২০০৩ সালে কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে ৫০-১০০ ফুট ভেতরে পাউবোর বাঁধ নির্মাণের পর বাঁধ থেকে তীর পর্যন্ত জায়গাটি অবৈধ দখলে চলে গেছে। ওই জায়গা রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সের সাবেক সদস্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রথম আলোকে বলেন, নদীর জায়গা বাইরে রেখে এভাবে হাঁটার পথ করলে অবশ্যই দখল হয়ে যাবে। অতীতেও তা দেখা গেছে।
বিআইডব্লিউটিএ জানায়, কাঁচপুর সেতু থেকে উজানে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুসংলগ্ন করিম জুট মিল পর্যন্ত ৩ দশমিক ২৫ কিলোমিটার এবং ভাটিতে শিমরাইল আম্বর পেপার মিল পর্যন্ত এক কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মিত হচ্ছে। এর সঙ্গে এক ফুট মাটির স্তর থাকবে। ভাঙন রোধে মোট এক লাখ ৮০ হাজার ব্লক বসানো হবে। এই প্রকল্পে খরচ হবে ১৭ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে সুলতানা কামাল সেতু এলাকায় হাঁটার পথ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ঢাল থেকে ৬০ ফুট ভেতরে হাঁটার পথ করে বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের দাবিই পরোক্ষভাবে মেনে নিল বিআইডব্লিউটিএ। কারণ, বিভিন্ন সময়ে তাঁরা এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন শিমরাইল শাখার সভাপতি নূর হোসেনও একই দাবির আভাস দিয়েছিলেন। গত ২৯ আগস্ট প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘নদীতীরে বালু ব্যবসা বন্ধ হলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। তাদের স্বার্থে আমরা অন্তত ২০ মিটার (৬০ ফুট) জায়গা ছেড়ে ওয়াকওয়ে করার জন্য মে মাসে দাবি জানিয়েছি।’
মে মাসে কাঁচপুরে ‘ওয়াকওয়ে’ চিহ্নিতকরণ কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএ নূর হোসেন ও তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
সম্প্রতি ডেমরায় গিয়ে দেখা যায়, করিম জুট মিলের কাছে শীতলক্ষ্যা তীরে প্রচুর ‘ব্লক’ রাখা। হাঁটার পথ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ চলছে। আশপাশে কিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সারুলিয়া বাজারের পেছনে নদীতীরে বালু ও পাথরের ব্যবসা চলছে। নদীর পানির কাছাকাছি ‘ওয়াকওয়ের’ লাল খুঁটি পোতা। আশপাশে রাখা বালু ও পাথরের কারণে ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ চোখে পড়ে না।
৬০ ফুট ভেতরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) শফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বালু ব্যবসাকে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করছি না। এ ছাড়া জায়গা যাতে দখল না হয়, সে জন্য বৃক্ষরোপণ করা হবে এবং নিয়মিত তদারকি থাকবে।’
কিন্তু ২০০৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারে কেরানীগঞ্জ মান্দাইল মাতৃসদন থেকে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু (প্রথম) পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের সময় তা নদীর সীমানার ৫০-১০০ ফুট ভেতরে হওয়ায় আপত্তি জানিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। বুড়িগঙ্গা নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সের সভায় বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধিরা এই আপত্তি জানান। তবে সভায় পাউবোর প্রতিনিধি জানান, প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় বাঁধ নির্মাণকাজ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে তখন পরিবেশবাদীরা আন্দোলনও করেছিলেন।
নদীতীর থেকে ওই বাঁধ পর্যন্ত পুরো জায়গা বর্তমানে অবৈধ দখলে চলে গেছে।
বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক (বন্দর) সৈয়দ মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টাস্কফোর্সের ওই সভা ছাড়াও পরবর্তী বিভিন্ন সভায় বুড়িগঙ্গার এই বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই বাঁধ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কাজগুলো করা উচিত। শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানার এত ভেতরে পায়ে চলার পথ তৈরির বিষয়টি দখলদারদের উৎসাহিত করবে।
হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা উল্লেখ করে বাপার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মতিন বলেন, নদীর ঢাল (ফোরশোর) থেকে ৫০ মিটার বা ১৫০ ফুট দূর পর্যন্ত কোনো খুঁটি বসানো বা হাঁটার পথ করা যাবে না। কারণ, নদীর জায়গা ওই পর্যন্ত। সরকার কোনো খুঁটি স্থাপন বা হাঁটার পথ করতে চাইলে ঢালের ৫০ মিটার দূরে করতে হবে। সেখানে ব্যক্তিমালিকানার জমি থাকলে জমি তাঁরই থাকবে, কিন্তু স্থাপনা করা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.