একই সূত্রে গাথা বিশ্ব ব্যাংকিং ক্রাইসিস, বিপন্ন ড. ইউনূস ও পদ্মা সেতু দুর্নীতি (শেষ পর্ব) by শফিক রেহমান

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়ে বিতর্ক আরো জোরালো হয়ে উঠেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড থেকে স্টিফেন সাকুর উপস্থাপিত হার্ডটক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইন্টারভিউ সম্প্রচারিত হবার পর। এই বিতর্ক তুঙ্গে উঠবে- এক. যখন হয়তো কোনো লঘু অপরাধ ‘প্রমাণিত’ হবার পর ড. ইউনূসকে জেলে ভরা হবে অথবা দেশান্তরী করা হবে এবং দুই. কোনো অন্ধ হাসিনা-সমর্থক বা আওয়ামী-ভক্ত আততায়ীর হাতে ড. ইউনূস নিহত হবেন।
দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই উড়িয়ে দেয়া উচিত হবে না। প্রসঙ্গত, মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি হু. মু. এরশাদ জেলে গিয়েছিলেন (গুরুতর অপরাধে) এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাবজেলে গিয়েছিলেন (অপ্রমাণিত অপরাধের অভিযোগে)। তবে ড. ইউনূস নোবেল বিজয়ী হওয়ায় তার জন্য স্পেশাল সাবজেল বানানো হবে না, সেটা বলা যায়। জেল বা সাবজেলে না পাঠিয়ে শেখ হাসিনার মতোই ড. ইউনূসকে দেশান্তরী করা হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দুই রাষ্ট্রপতি, শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন, যে হামলায় তিনি নিহত হতে পারতেন। এ ছাড়াও আরো অনেক রাজনৈতিক হত্যা ও হত্যাপ্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।

ইউনূস এখন আর শুধু নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ নন। তিনি এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাড়িয়েছেন। তার বিপদটা সেখানেই। শোনা যায়, তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হামলার জন্য বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল থেকে তাকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটা নাকচ করে দিয়েছেন।

দুটি মূল প্রশ্ন
ড. ইউনূস বিতর্কের দুটি মূল প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো আসেনি। সেই দুটি প্রশ্ন হলো :


এক. কেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী মন্ত্রিসভার একাংশ ও আওয়ামী লীগ যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন?

দুই. কেন ড. ইউনূসকে রক্ষার জন্য আমেরিকান সরকার ও বৃটেনসহ ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু সরকার এগিয়ে এসেছে?

এই দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই ‘একই সূত্রে গাথা বিশ্ব ব্যাংকিং ক্রাইসিস, বিপন্ন ড. ইউনূস ও পদ্মা সেতু দুর্নীতি’ শীর্ষক লেখাটির অবতারণা করা হয়েছে। পাঠক লক্ষ্য করেছেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে, আমি সেটা করেছি পশ্চিমের চলমান ব্যাংকিং ক্রাইসিসের একটা ওভারভিউ দিয়ে।

ন্যাড়া বেলতলায়
পশ্চিমের ব্যাংকসমূহে যখন সেই সংকটের সূচনা হয়, প্রায় ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকে সংকটের শুরু হয়। তবে গ্রামীণের সংকট কোনো অর্থনৈতিক কারণে নয় Ñ এটি সূচিত হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নভেম্বর ২০০৬-এ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ড. ইউনূস আনন্দিত হয়েছিলেন এটা ভেবে যে, তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জাতীয়ভাবে সফল হয়েছে এবং সেটা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেল। এই অনুভূতি থেকে সৃষ্ট গভীর আত্মবিশ্বাসে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সেনাসমর্থিত সরকার আগমনের পর তিনি একটি রাজনৈতিক দল (নাগরিক শক্তি পার্টি) গঠনের উদ্যোগ নেন। তার সেই উদ্যোগ টেক অফ করার আগেই ক্র্যাশ করে যায়। ড. ইউনূস প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলতে বাধ্য হন, তিনি আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবেন না। তিনি বলেছিলেন, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।

ড. ইউনূস অবশ্য ন্যাড়া নন। আওয়ামী সরকারের অবিরাম প্রচারণায় আমরা জানি ড. ইউনূস সত্তরোর্ধ্ব। তবুও তার মাথায় অন্যান্য সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তির (যার অন্যতম অর্থমন্ত্রীও) ঈর্ষণীয় পরিমাণে অনেক চুল আছে। এ দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে আমি পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কি আবার কখনো রাজনীতিতে ঢোকার ইচ্ছা পোষণ করেন?
উত্তরে ইউনূস আবারো বলেন, না। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।

এখন সমস্যাটা হচ্ছে এই যে, তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিলেও রাজনীতি তাকে ছাড়ছে না। ছাড়বেও না।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ন্যাড়াকে আবার হয়তো বেলতলাতেই যেতে হবে দেশের প্রয়োজনেই, তবে যেভাবে তিনি ২০০৭-এ রাজনীতিতে যেতে চেয়েছিলেন সেভাবে নয়। অর্থাৎ এককভাবে নয়। আমেরিকায় শিক্ষিত ড. ইউনূস নিশ্চয়ই জানেন, বিশ্বের সব নোবেল বিজয়ীর অনেকেই আমেরিকান হলেও তারা আমেরিকান রাজনীতিতে যাননি। তারা জানেন সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে ভোটে রূপান্তরিত করা অন্য ধরনের বল গেম (Ball Game)। এ জন্যই জর্জ ডাবলিউ বুশের মতো ডিসলেক্সিক (Dyslexic) পেশেন্ট (পড়াশোনায় যার সমস্যা আছে) ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের ব্যক্তি দুই দফায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। হ্যা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট (বারাক ওবামা), ভাইস প্রেসিডেন্ট (আল গোর) নোবেল পেয়েছেন। তবে প্রেসিডেন্ট হবার আগে নয়, পরে।

আমেরিকাতেও পরিবারতন্ত্র
আমেরিকাতেও পরিবারতন্ত্র চলেছে। বুশ পরিবারের সদস্যরা (জর্জ হার্বার্ট বুশ ও তার ছেলে জর্জ ডাবলিউ বুশ) বারো বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিনটন পরিবারের সদস্যরা আট বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ও চার বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। হিলারি কিনটন যদি ২০০৮-এ ডেমক্রেট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রূপে নমিনেশন পেতেন, তাহলে কিনটন পরিবার বারো বছর হোয়াইট হাউসে থাকত। অর্থাৎ, বুশ ও কিনটন পরিবারের সদস্যরাই একটানা চব্বিশ বছর ক্ষমতার শীর্ষে থাকতেন এমন একটি দেশে যেখানে নোবেল বিজয়ীদের সংখ্যা অনেক।


এই ঘটনা থেকে সাবেক শিক্ষক ইউনূসের শেখার আছে যে, বাংলাদেশে যত দিন দুই পরিবারতন্ত্র রাজনীতির দুই নিয়ামক শক্তি রূপে আছে, তত দিন তাদের এড়িয়ে তিনি রাজনীতিতে এগোতে পারবেন না, যেমনটা ড. কামাল হোসেন পারেননি। সে ক্ষেত্রে তাকে চলমান মূলধারার রাজনীতি অর্থাৎ মেইনস্টৃম পলিটিক্সে যোগ দিতে হবে। হয় আওয়ামী লীগে নতুবা বিএনপিতে।

২০০৭ বনাম ২০১২
ড. ইউনূসের মাথার সব চুল না পড়ে গেলেও অথবা পারসনাতে গিয়ে মাথা না কামিয়ে ফেললেও আওয়ামী লীগ ড. ইউনূসের রাজনৈতিক সম্ভাবনা এবং পুনঃআবির্ভাবকে ২০০৭ থেকেই গণনার মধ্যে রেখেছে। কিন্তু সেটাই কি ড. ইউনূসের চরিত্র হননের প্রধান কারণ? আবার আরেকটি সাধারণ নির্বাচন আসছে। হয়তো বা আবার তৃতীয় শক্তি আসছে। তখন কি আবার ড. ইউনূস তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনীতিতে ফিরে আসার ঘোষণা দেবেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ৫৭ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে রিটায়ার করার ঘোষণা দিয়েও এখনো রাজনীতিতেই আছেন এবং স্টিফেন সাকুরের কাছে বলেছেন, দল ও জনগণ চাইলে অবশ্যই তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাহলে শেখ হাসিনা কি এখন ভীত যে, এখন থেকে মার্চ ২০১৪-এর মধ্যে যেকোনো সময়ে ড. ইউনূস আবার রাজনীতিতে ফিরে আসবেন? শেখ হাসিনার কি মনে পড়ে যায় তার শৈশবের বন্ধু ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা, যিনি আনুগত্য বদলানোর সময়ে প্রায়ই বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলিয়া কিছুই নাই!

শেখ হাসিনা যদি ভীত হয়ে থাকেন, তাহলে তার সঙ্গত কারণ আছে। জানুয়ারি ২০০৭-এ শেখ হাসিনার যে অবস্থান ছিল সেটা জানুয়ারি ২০১২-তে বদলে গিয়েছে। ঠিক তেমনি ড. ইউনূসের অবস্থানও বদলে গিয়েছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেত্রী। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। জানুয়ারি ২০০৭-এ ড. ইউনূস ছিলেন রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার যে বহু বন্ধু আছে সেটা ছিল তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। জানুয়ারি ২০১২-তে দেশে খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির বহু নেতা-কর্মী-সমর্থক তার পাশে দাড়িয়েছেন। ১২ আগস্টে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দলীয়ভাবে নয়, জাতীয়ভাবে ড. ইউনূসকে স্বীকৃতি দেয়া হবে, তাকে সম্মানিত করা হবে, তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেয়া হবে।

রাজনৈতিক দলের বাইরে বহু সচেতন নাগরিক তার পক্ষে এসেছেন। দেশের ৪৬ বিশিষ্ট নারী ১৩ আগস্ট তার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন।

আর বিদেশে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনসহ অনেকেই ড. ইউনূসের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। ১২ আগস্টে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের পৃন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি জেফৃ প্যাট ভয়েস অফ আমেরিকায় এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে বেসরকারি উদ্যোগ ও সিভিল সোসাইটির সাফল্যের উদাহরণরূপে বিবেচনা করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও নাগরিকরা গর্ব করতে পারেন। নোবেলজয়ী এই ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না, যাতে এর স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। ...বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে থাকা ঋণগ্রহীতা নারী অংশীদারদের ক্ষমতা খর্ব হতে পারে।

সুতরাং বলা যায়, ২০০৭-এ নাগরিক শক্তি পার্টির দুর্বল উদ্যোক্তা ড. ইউনূস ২০১২-তে দেশে ও বিদেশে জনসমর্থনে শক্তিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

আর সেখানেই শেখ হাসিনার ভয়ের কারণ। তিনি জানেন, বর্তমান প্রেক্ষিতে মূলধারার রাজনীতিতে ড. ইউনূসের একমাত্র গন্তব্যস্থল হতে পারে বিএনপি। শেখ হাসিনা এটাও জানেন যে, ২০০৭-এ ড. ইউনূসকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তাব জেনারেল মইন দিয়েছিলেন। ড. ইউনূস সেটা প্রত্যাখ্যান করে ড. ফখরুদ্দীনের নাম সুপারিশ করেছিলেন এবং সেভাবেই ড. ফখরুদ্দীন হয়েছিলেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, ড. ইউনূস সেনাবাহিনীর পুতুল প্রধান উপদেষ্টা হতে চাননি। এই তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, এখনো ড. ইউনূস সেনাবাহিনীর পুতুল হবেন না। রাজনীতি করতে হলে তিনি রাজনৈতিক দলে থেকেই করবেন।

প্রশ্ন হতে পারে Ñ কেন ড. ইউনূস রাজনীতি করবেন? উত্তরটা হতে পারে, শেখ হাসিনা যেমন তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য রাজনীতি করছেন ও করবেন এবং ইউনূস-বিরোধী থাকবেন Ñ ঠিক তেমনি ইউনূসকেও রাজনীতি করতে হবে এবং হাসিনা-বিরোধী হতে হবে তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই।

কিন্তু রাজনীতি তথা বিএনপি ড. ইউনূসের সম্ভাব্য নিরাপত্তা ও আশ্রয়স্থল হতে পারে বলেই কি শেখ হাসিনা ও তার দলবল এত প্রচণ্ড ইউনূসবিরোধী হয়েছেন? অন্য কোনো কারণ কি থাকতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে বিবেচনা করুন ইউনূস-বিরোধী হাজার মন্তব্যের মধ্যে নিচের মাত্র কয়েকটি:

সুদখোর আর ঘুষখোর একই কথা।
- আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা।

বিশ্বের বেশ কিছু রাজধানীতে চিপস, চিজ স্যান্ডউইচ আর হোয়াইট ওয়াইন খাওয়ালে জনপ্রিয়তা বাড়ে। সময় মতো একটি নোবেল পুরস্কারও পাওয়া যায়। ... ত্রাণ ভিক্ষার চাল আর তথাকথিত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে হাজার বছরেও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। বিশ্বের কোনো দেশে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত নেই। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে জড়িত কেউ একজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কোন যুদ্ধে তিনি শান্তি এনেছেন? কোন মহাদেশে তিনি শান্তি এনেছেন? কোথায় তিনি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করেছেন?
- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ১০ মে ২০১২ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে।

আপনারা নোবেল প্রাইজ পাওয়াকে এত বড় করে দেখছেন কেন? নোবেল প্রাইজ যদি পেতে হয়, আমি বলব দুজনের পাওয়া উচিত ছিল, শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমা।
- অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম,সাংবাদিকদের, ৮ মার্চ ২০১১।

আমি একশবার বলেছি, ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সঠিক কথা বলছেন না। উনি মিথ্যাচার করছেন, প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন। প্রথম দিন থেকেই উনি বলছেন, সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায়। প্রথম দিন থেকেই এটা মিথ্যা। সরকার এখন পর্যন্ত এটা দখল করে নাই। দখল করতেও চায় না।... গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আননেসেসারি ক্যামপেইন (অযথা আন্দোলন) হচ্ছে। ইটস হার্মফুল ফর দি কান্টৃ (এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর)। ... ক্ষুদ্র ঋণ প্রসারে আরেকজন লোক আছে। যে লোক এখানে বসে আছেন। (এই সময়ে অর্থমন্ত্রী) নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দেন সেই ব্যক্তি তিনিই। এর পর তিনি আরো বলেন,) ... ইউনূস সাহেব ক্ষুদ্র ঋণের প্রসারকে ৪, ১০ বা ১২ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। আমি সেটাকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছি...
- অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আবদুল মুহিত, টিআইবি-র অনুষ্ঠানে ১২ আগস্ট ২০১২।

ড. ইউনূসের যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাহলে এ প্রতিষ্ঠান কে চালাবে? এ প্রতিষ্ঠান কি চলবে না? ... এই দেশটা সাম্রাজ্যবাদীদের একটা উপনিবেশ হিসেবে তৈরি করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আর এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন ড. ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক সুদের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে না তুলে তিনি নোবেল পেয়েছেন শান্তিতে।

- আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, স্বাচিপের অনুষ্ঠানে ১২ আগস্ট ২০১২।

সংক্রামক আই প্রবলেম
প্রধানমন্ত্রী যে আই প্রবলেমে (Eye বা চোখ নয়, ও অর্থ আমি) ভোগেন, সেটা স্টিফেন সাকুর ইন্টারভিউয়ের শেষে ডায়াগনোসিস করে বলে দিয়েছিলেন। আর অর্থমন্ত্রীও যে আই প্রবলেমে (আমি, আমার) ভোগেন, সেটা আগেই বিদিত ছিল- ১২ আগস্ট ২০১২-তে তিনি আবার নতুন করে জানান দিয়েছেন মাত্র। তবে এবার তার শুভাকাক্সক্ষীরা শংকিত হচ্ছেন এটা ভেবে যে, অংক করে অর্থমন্ত্রী নিজেই কি নোবেল প্রাইজ দাবি করলেন? সে ক্ষেত্রে এই প্রাইজের প্রবীণ দাবিদার প্রধানমন্ত্রীর রোষের শিকার তো তিনিও হতে পারেন। প্লিজ টেক কেয়ার!


আর ১২ আগস্ট ২০১২-তে মাহবুব-উল আলম হানিফের বিবৃতিতেও ড. ইউনূস সম্পর্কিত মৃত্যুচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে, যদিও মা-উ আ হানিফ ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর কথা বলেছেন।

পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা
এসব উক্তি, বিবৃতির আলোকে মনে করা যেতে পারে, ড. ইউনূস নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলেই আওয়ামী নেত্রী-নেতাদের এত উষ্মা! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিনটনও এটা ভেবেই বলেছিলেন, ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বয়সের ছুতা ধরে সরানো হয়েছে। কিন্তু এটা আসল কারণ বলে আমরা মনে করি না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সমাজে কখনো গ্রহণীয় হবে না। তিনি বলেন, ড. ইউনূস হচ্ছেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। অন্ধকারে বাতিঘরের মতো যিনি বিশ্বের অগণিত মানুষকে বাচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তার আবিষ্কৃত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ নিজ পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। তবে এটা অত্যন্ত মর্মবেদনার বিষয় যে, সেই লোকটিকে বাংলাদেশে অপমান করা হয়েছে।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের ক্যামপেইনের কারণ পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা হলেও হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী মনস্তত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কেউ কেউ বলেন, অন্য কারণও থাকতে পারে। তারা বলেন, স্বদেশে সংবিধান থেকে শুরু করে টেক্সট বুক পর্যন্ত, কারেন্সি নোট থেকে শুরু করে কয়েন (মুদ্রা)পর্যন্ত, যমুনা বৃজ থেকে শুরু করে চীন-বাংলা মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র, পিজি হসপিটাল, কৃষি ইউনিভার্সিটি, নভো থিয়েটার ইত্যাদিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রতিষ্ঠা, পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেও বিদেশে এখন ড. ইউনূসের নামেই বাংলাদেশ পরিচিত হয়। শেখ মুজিব প্রয়াত হয়েছেন ১৯৭৫-এ, ৩৭ বছর আগে। বিদেশের নতুন প্রজন্ম নোবেল প্রাইজ ও গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে ড. ইউনূসকেই জানে, শেখ মুজিবকে নয়। এটাও শেখ হাসিনার মনস্তাপের কারণ হতে পারে।

শেখ হাসিনার নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি যারা বিশ্লেষণ করেন তারা আরেকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তারা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো তারল্য সংকট নেই। আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি সরকারি ঘোষণায় সুদ মওকুফ করে দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের আশি লক্ষাধিক ঋণগ্রহীতার ভোট কুক্ষিগত করতে চাইতে পারেন শেখ হাসিনা। তাই অগ্রিম বিদায় দেওয়া হয়েছে ইউনূসকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূস বিরোধিতার একাধিক কারণ হতে পারে। কিন্তু এ সবই কি যথেষ্ট?

এক. সাধারণ নির্বাচনে ভোট জয়ের কৌশল তো শেখ হাসিনা করতেই পারেন। কে তাকে বাধা দেবে?

দুই. বহির্বিশ্বে শেখ মুজিবের বহুল পরিচিতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। আগের মেয়াদে শেখ হাসিনা বৃটেনের ডারহাম ইউনিভার্সিটিতে একটি বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেন। এখন সিডনি, টোকিও, সিঙ্গাপুর, বেইজিং, প্যারিস, লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে বঙ্গবন্ধু পিস (Peace) সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেংকারিতে চুরি হয়ে যাওয়া ৩,৫৪৭ কোটি টাকার কমে।

তিন. পশ্চিমের সভ্য দেশগুলো বহু বছর যাবৎ মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করেছে। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের পেছনে শেখ হাসিনার সমর্থন থাকলে সুইডেন-নরওয়ে কিভাবে তিনি শান্তিতে নোবেলপ্রত্যাশী হবেন? তার পরও পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার প্রকাশ না ঘটিয়ে নোবেল বিজয়ের জন্য প্রকৃতই শান্তিবাদী হতে সচেষ্ট হতে পারেন শেখ হাসিনা।

চার. কেউই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। সব মানুষের মধ্যেই ভালো-মন্দ মেশানো। ড. ইউনূসও নিশ্চয়ই ভালো-মন্দ মিশিয়ে মানুষ। তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে কিছু ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। সেই ‘অপরাধে’ তাকে দণ্ডিত করে কোনো রাষ্ট্রীয় পদে তাকে অযোগ্য ঘোষণা অথবা কোনো নির্বাচনে তার অংশ নেয়াকে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে।

অন্যভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনা যদি চান তাহলে তার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং দলীয় মনোভাবকে সংযত করতে পারেন। এটা তার ইচ্ছার ব্যাপার মাত্র।

পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে এসএনসি-লাভালিন
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে দিকে না গিয়ে মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগকে চালিত করছেন আরো ধারালোভাবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা স্বদেশে ইউনূসের পক্ষে মতামতকে পাত্তা দিচ্ছেন না এবং বিদেশে ইউনূসের সমর্থনে বিবৃতিসমূহকে উপেক্ষা করছেন। এটা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ও বিদেশে বহুজনের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি হারাচ্ছেন। এসব জেনে ও বুঝেও তিনি ইউনূস-বিরোধিতাকে আরো সামনে নিয়ে যাচ্ছেন।

এর কারণ, এটা না করে তার উপায় নেই।

এর কারণ, পদ্মা সেতু প্রকাশ্যে দুর্নীতির যে অভিযোগ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এনেছে সেই দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি।

আগামী বছর ২০১৩-র এপৃলে এই দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট মন্টৃঅল-ভিত্তিক কানাডার সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি এসএনসি-লাভালিন (SNC-Lavalin)-এর কিছু কর্মকর্তার বিচার শুরু হবে। এই কম্পানির কিছু অফিসার ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। লাভালিনের স্লাশ (Slush) ফান্ড বা ঘুষ ও কমিশন দেওয়ার তহবিল ছিল টিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূত এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াদ বেন আইসার কাছে। ৩০ এপৃল ২০১২-তে আইসা গ্রেফতার হয়েছেন সুইজারল্যান্ডে। এর পরে তার দুই সহযোগী পরেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইবরাহিম গ্রেফতার হয়েছেন। এদের এখন কানাডায় নিয়ে যাওয়ার আইনি প্রক্রিয়া চলছে। গত মার্চে এসএনসি-লাভালিনের সিইও পিয়ের ডুহেইম রিজাইন করেন। পদত্যাগপত্রে তিনি এই দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেন। লাভালিনের শেয়ারের দাম ২৮% পড়ে গিয়েছে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২-তে এই কোম্পানির কনস্ট্রাকশন ইউনিটে অনিয়মের অভিযোগের পরেই শেয়ারের দাম পড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি ২০১২-তে এসএনসি-লাভালিন স্বীকার করেছিল তাদের ৫৬ মিলিয়ন ডলার এমন সব খাতে খরচ হয়েছে, যা নিয়ে তারা এখন তদন্ত করছে। ২৬ মার্চ ২০১২-তে কম্পানি জানায়, বেন আইসা কানাডা ও টিউনিসিয়া, উভয় দেশের নাগরিক। যেসব লেনদেনের তদন্ত হচ্ছে তার বেশির ভাগ সম্পর্কে বেন আইসা জানেন। (সূত্র : ওয়ার্ল্ড ফাইনানশিয়াল পোস্ট ৩০.০৪.২০১২)

তাই এই কম্পানির প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ শেয়ারহোল্ডাররাও একই দাবি জানাচ্ছেন। ১০ এপৃল ২০১২-তে কানাডিয়ান সরকার ঘোষণা করে, এসএনসি-লাভালিনে অনিয়ম বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে তদন্তে তারা পূর্ণ সহযোগিতা করবে। পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড বলেন, এই কম্পানির বিরুদ্ধে সিরিয়াস অভিযোগ করা হয়েছে। তাই সিরিয়াস তদন্ত করা হবে।... কানাডা অথবা বিদেশে যে বা যারা আইন ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে কানাডা সরকার সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।

সুইস স্টেট প্রসিকিউশনের মুখপাত্র জিনেট বালমার জানান, দুর্নীতি, প্রতারণা ও মানি লনডারিং বিষয়ে ফৌজদারি তদন্ত চলছে।

এপৃল ২০১২-তে ঢাকায় নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ধারণা করা হয়, লাভালিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি শেখ হাসিনাকে জানান। লাভালিন কানাডার সরকারি প্রতিষ্ঠান নয় যে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সেখানে তদন্তের প্রক্রিয়া স্থগিত করা যাবে। কানাডাতে আইনের চাকা ঘুরছে। মামলা শুরু হলে এক পর্যায়ে ফাস হবে বাংলাদেশের কে বা কারা অথবা কোন প্রবাসী বাংলাদেশী এই দুর্নীতির সঙ্গে কিভাবে এবং কি পরিমাণে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার পৃ-এম্পটিভ অ্যাকশন
শেখ হাসিনা জানেন সেই দুঃসময় অনিবার্য এবং সেটা ঘটবার আগেই ড্যামেজ লিমিটেশন অ্যাকশনে অর্থাৎ ক্ষতি সীমিতকরণে যেতে হবে। তাই তিনি পৃ-এম্পট (Pre-empt) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- এপৃল ২০১৩-র আগেই তিনিই অ্যাকশনে গিয়েছেন।

এপৃল ২০১৩-তে কানাডাতে ওই মামলা শুরু হবার সময়ে তিনি ও তার দলবল বলতে পারবেন, যেহেতু আমরা ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিদায় করেছি, সেহেতু ইউনূসেরই চক্রান্তে বিদেশে একটা সাজানো মামলায় মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে এসএনসি-লাভালিনের দুর্নীতির সঙ্গে কোনো বাংলাদেশীর বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মামলা ইউনূসের ষড়যন্ত্র।

শেখ হাসিনা আশা করছেন তার এই বক্তব্য আওয়ামী সমর্থক ও ভোটাররা বিশ্বাস করবে। কারণ তারা জানে, স্বদেশে এই মুহূর্তেও কয়েকটি সাজানো মামলা চলছে, যা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তা ছাড়া, ড. ইউনূসের সঙ্গে বিদেশীদের ঘনিষ্ঠতা আছে। তিনি হিলারি ও বিল কিনটনের বন্ধু। প্রেসিডেন্ট ওবামার মা-ও ড. ইউনূসের ভক্ত ছিলেন। ড. ইউনূস এসব কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইছেন এই মর্মে আওয়ামী লীগের ব্যাপক প্রচারণা করা হবে, যার লক্ষণ জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর থেকে দেখা যাচ্ছে।

সুতরাং ২০১৩ অথবা ২০১৪-র প্রথম দিকে যে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে, সেখানে শেখ হাসিনার ক্ষতির পরিমাণ সীমিত হবে। ইউনূসকে দোষারোপ করে শেখ হাসিনা উৎরে যাবার চেষ্টা করবেন।

পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা পেরিফেরাল (Peripheral) বা হালকা কারণ মাত্র।


সুতরাং ইউনূস বিরোধিতার প্রধান কারণ হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্প দুর্নীতিতে কোনো বাংলাদেশীর সম্পৃক্ততা এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনে সেই সম্পৃক্ত ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে শেখ হাসিনার নিজেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত।

পশ্চিমে সামগ্রিক মন্দাবস্থা
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটি, অর্থাৎ কেন পশ্চিম, বিশেষত আমেরিকা এত সচেষ্ট ও তৎপর হয়েছে ড. ইউনূসকে রক্ষা করতে?

এই উত্তর দেওয়ার আগে একটু ব্যক্তিগত কথা বলা প্রয়োজন। মধ্য জুন ২০১২ থেকে আমি মধ্য জুলাই ২০১২ পর্যন্ত লন্ডনে ছিলাম। এর আগেই আমি জানতাম গৃস, ইটালি, স্পেন, পর্টুগাল, আয়ারল্যান্ড ও আইসল্যান্ডে ব্যাংকিং সংকট ঘনীভূত হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে ইওরোপ ও আমেরিকাতে মন্দাবস্থা চলছে। লন্ডনে থাকার সময়ে বিশেষত গ্রেট বৃটেনের ব্যাংকিং সংকট জুনের শেষ দিকে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। সুপারমার্কেট, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, রেলওয়ে ও সাবওয়ে স্টেশন এবং নিউজপেপার স্টলে, সর্বত্রই বড় বড় হেডলাইনে বার্কলেজ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের দুর্নীতির সংবাদ দেখতে পাই। রেডিওতে একই প্রসঙ্গ শুনতে পাই। টেলিভিশন অন করলে একই রিপোর্ট দেখতে পাই। বলা যায়, সমগ্র ইউকে ডুবে ছিল ব্যাংকিং সংকট আলোচনায়। অলিম্পিক শুরু হওয়া পর্যন্ত বৃটিশদের নজর এদিকেই ছিল।

বৃটেন তথা পশ্চিমে ব্যাংকিং সংকটের ফলে ইওরো মুদ্রা তথা ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে এবং চলবে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাই চেষ্টা করছে যার অল্প কিছু নমুনা ও বিবরণ এই লেখার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে আমি দিয়েছি।

সংকট প্রকাশিত হবার সময়ে কাকতালীয়ভাবে আমি লন্ডনে থাকায় ওই অ্যামবিয়েন্স (Ambience) বা পরিবেশটার সঙ্গে পরিচিত হই ও সেটার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করি।
আমি লক্ষ্য করি, ব্যাংকিং সংকট কাটানোর পথে ইউকেতে শুরু হয়েছে মাইক্রো ব্যাংকিং। টেসকো সেইনসবেরি ও আসদা (ওয়ালমার্ট) সুপারমার্কেট এবং মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইনসমূহ তাদের দোকানে ব্যাংকিং সার্ভিস দেয়া শুরু করেছে। খাবার, পানীয় এবং বিভিন্ন পণ্য বিক্রির পাশাপাশি তারা ব্যাংকিং সার্ভিসও দিচ্ছে। ফলে তাদের ওভারহেড কস্ট কম থাকছে এবং এতে তারা ও কাস্টমারÑ উভয়েই লাভবান হচ্ছে। বৃটিশ ফাইনানশিয়াল কলামিস্টরা মনে করছেন চলমান ব্যাংকিং সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম পন্থা হতে পারে ব্যাংকিং সার্ভিসের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে কম ওভারহেড কস্ট-এ ছোট ছোট বহু ব্যাংক চালু করা এবং পাশাপাশি বড় ব্যাংকগুলোকে ভেঙে দেওয়া।

পশ্চিমের নিজের স্বার্থই মুখ্য
আর এই কারণেই ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নাম বিদেশে বারবার উঠে আসছে। পশ্চিম তার নিজের স্বার্থে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংককে বাচিয়ে রাখতে চায়। হিলারি ও বিল কিনটনের সঙ্গে ইউনূসের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা এখানে একেবারেই গৌণ।

লন্ডন থেকে ফিরে এসে গত ৭ আগস্ট ২০১২-তে আমি ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, আ: লী:-র নোবেলতাত্ত্বিক সাধারণ সম্পাদক, ষড়যন্ত্র বিশেষজ্ঞ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, দিনকে রাত অথবা রাতকে দিন কিংবা অলিম্পিককে ফুটবল পৃমিয়ার লীগ অথবা পৃমিয়ার ফুটবল লীগকে অলিম্পিক Ñ যাই বলুন না কেন, ফ্যাক্ট হচ্ছে :


এক. ড. ইউনূস স্বেচ্ছায় গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ ছেড়ে দেননি। তিনি আওয়ামী সরকার দ্বারা ওই পদ থেকে চ্যুত হয়েছেন।

দুই. গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ৪৫% (শেখ হাসিনা-কথিত) নয়।

তিন. গ্রামীণ ব্যাংকের আশি লক্ষাধিক ঋণগ্রহীতার অধিকাংশই ড. ইউনূসকে স্বপদে পুনর্বহাল রূপে দেখতে চান।

১৩ আগস্ট ২০১২-তে অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিতের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলছি। আমরা একমত হয়েছি যে, গ্রামীণ ব্যাংকে দক্ষ ও শক্তিশালী একজন এমডি নিয়োগ দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেও আমরা একমত হয়েছি। ড্যান মজিনা বলেন, আমরা আরো একমত হয়েছি, প্রতিষ্ঠানটিতে এমন একটি স্বতন্ত্র পর্ষদ থাকা দরকার যাতে ঋণগ্রহীতাদেরই এমডি নিয়োগের ক্ষমতা থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকে স্বতন্ত্র একটি কাঠামো থাকা দরকার। গ্রামীণ ব্যাংক একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকবে- এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীও একমত হয়েছেন।

পরদিন ১৪ আগস্ট ২০১২ দুপুরে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আমি বলেছি যে, গ্রামীণ ব্যাংক সরকার দখল করেছে বলে ড. ইউনূস যা বলে বেড়াচ্ছেন, সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এটা ঠিক যে, গত দেড় বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঋণগ্রহীতারা ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করায় সিলেকশন প্রক্রিয়ায় কেবল তার নামই চলে আসে। কিন্তু তিনি তো আর এমডি হতে পারেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী ব্যাংকের এমডি মনোনয়ন দেবে পরিচালনা বোর্ড। তবে এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের সুপারিশ লাগবে।....গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগের জন্য দেশে-বিদেশে উপযুক্ত লোক রয়েছে, এ অবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংকের একজন উপযুক্ত এমডি নিয়োগের জন্য ‘আন্তর্জাতিক আগ্রহপত্র’ (ইন্টারন্যাশনাল এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য অনেক বিদেশী বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।.....সোমবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত দু’টি বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রথমত, ঋণগ্রহীতারাই এমডি নির্বাচন করবেন এবং দ্বিতীয়ত গ্রামীণ ব্যাংকের এমডিকে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হতে হবে।...

কে সচেতন ও সক্ষম?
ঋণগ্রহীতা কর্তৃক এমডি নির্বাচন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, অতটা সচেতনতা বা সক্ষমতা এখন তাদের হয়নি। তারা মনে করেন, ড. ইউনূস থাকলেই সব ঠিক। কিন্তু বর্তমানে নতুন ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে এ প্রবণতা তেমন নেই। এখন নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হলেই ঋণগ্রহীতারা বুঝতে পারবেন যে, তিনি কতটা যোগ্য।

অনেকেরই হয়তো সচেতনতা বা সক্ষমতা বিষয়ে অর্থমন্ত্রীরই অকপটে স্বীকারোক্তি মনে পড়ে যাবে। তিনি শেয়ারবাজার বিষয়ে তার অজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। এই সারল্য প্রশংসনীয় ছিল। কিন্তু এর ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী প্রায় ৩৩ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষোভ ও সমালোচনা তার প্রাপ্য ছিল। পরবর্তীকালে দেখা গেছে এমএলএম মালটিলেভেল মার্কেটিং বিষয়েও তিনি সচেতন বা সক্ষম ছিলেন না। যার ফলে ইউনিপেটুইউ এবং ডেসটিনিসহ প্রায় ৩৩টি এমএলএম কম্পানি দ্বারা পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ প্রতারিত হয়েছে।

এদের অন্যতম হচ্ছে আমার ড্রাইভার ও তার স্ত্রী যারা বিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় দু’টি বিশেষ ধরনের গাছের ‘মালিক’ হয়েছে! আমি তাদের তিরস্কার করে বলতে বাধ্য হয়েছি তাদের গ্রামের বাড়িতে দুটি নারকেল গাছ লাগালেও তারা লাভবান হতো।

ডায়মন্ড হতে সাবধান
অর্থমন্ত্রী তথা আওয়ামী সরকার যে কতো সচেতন ও সক্ষম সেটা বোঝা যায় ১১ আগস্ট ২০১১-তে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি খবরে :

রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকার ডায়মন্ড কমার্স অ্যান্ড ফাইনান্স নামে এক মাল্টিপারপাস কম্পানি পাচ শতাধিক গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণার শিকার বিুব্ধ গ্রাহকরা ১০ আগস্ট ২০১২ শুক্রবার সকালে মহিউদ্দিন মার্কেটে মাল্টিপারপাস কার্যালয়ের সামনে দফায় দফায় বিক্ষোভ করে। কয়েকদিন ধরে কম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মগোপন করে আছেন। প্রতারিত গ্রাহক গোলাম হোসেন, শরীফ মিয়া, সাইফুল ইসলাম, আবু মিয়া, মামুন মিয়া, শাহ আলমসহ আরো অনেকেই জানান, প্রায় দুই বছর আগে উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকায় মহিউদ্দিন মার্কেটে ডায়মন্ড কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স নামে এক মাল্টিপারপাস কম্পানির কার্যালয় খোলা হয়।

মাল্টিপারপাসের ওই কার্যালয়ে থেকে টিভি, ফৃজ, ফ্যান, সেলাই মেশিনসহ ডায়মন্ড স্টিকার লাগানো পণ্যসামগ্রী সহজ কিস্তিতে গ্রাহক ও ক্রেতাদের দেয়া হতো। এরপর বেশি লাভ দেখিয়ে ডিপিএস ও ব্যাংক একাউন্ট করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে মাল্টিপারপাসের কর্মকর্তারা। মাল্টিপারপাসাটিতে গোলাকান্দাইল, বলাইখা, আউখার, বালিয়াপাড়া, হোড়গাওসহ কয়েকটি এলাকার পাচ শতাধিক নারী-পুরুষ গ্রাহক রয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই গার্মেন্টস শ্রমিক। ঈদ উপলক্ষে গ্রাহকরা মাল্টিপারপাস থেকে টাকা তুলতে গেলে কর্মকর্তারা টালবাহানা করতে থাকে।


কয়েকদিন আগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম বাহাউদ্দন পালিয়ে যান। মাল্টিপারপাসের ম্যানেজার রমা আক্তার ও মাঠকর্মী শাওন, আমেনা, সনিয়া গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধ করবে বলে বিভিন্নভাবে আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন। শুক্রবার সকালে হঠাৎ ম্যানেজার রমা আক্তার মাল্টিপারপাসের কার্যালয় থেকে টিভি, ফৃজ, ফ্যান, সেলাই মেশিনসহ পণ্যসামগ্রী পিকআপযোগে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় গ্রাহকরা খবর পেয়ে মালবাহী পিকআপ আটক করে। এক পর্যায়ে রমা আক্তার পালিয়ে যান। এর পরই বিুব্ধ গ্রাহকরা মাল্টিপারপাসের সামনে দফায় দফায় বিক্ষোভ করতে থাকে।

গোলাকান্দাইল এলাকার গ্রাহক সাফিয়া আক্তার জমা রেখেছিলেন ১২ হাজার টাকা। টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে সংবাদে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, বাবারে অনেক কষ্টের এ টেহা। হারামিরা এ টেহা মাইরা খাইলে শান্তি অইবো না। একই এলাকার লুৎফা আক্তার বলেন, গার্মেন্টসে কাম কইরা খাইয়া না খাইয়া ১০ হাজার টেহা মাল্টিপারপাসে জমাইছি।

গোলাকান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ আবদুল মতিন জানান, ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব মাল্টিপারপাস। আর এসব প্রতিষ্ঠান গ্রামের সহজ সরল মানুষের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি। এ ব্যাপারে মাল্টিপারপাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম বাহাউদ্দিন ও ম্যানেজার রমা আক্তারের সঙ্গে তাদের সেলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

সুতরাং আমার যৌক্তিক সাজেশন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের সচেতনতা বা সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে তাদেরই ইচ্ছা মতো তাদের ব্যাংককে চলতে দিন।

ও হ্যা! বৃটেনে বার্কলেজ ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ সিইও বব ডায়মন্ড আর বাংলাদেশে পলাতক বাহাউদ্দিনের কম্পানির নামেও ডায়মন্ড যুক্ত! এমনকি ডেসটিনিতেও ডায়মন্ড গ্রাহক হওয়ার হাতছানি আছে! কি আশ্চর্য যোগাযোগ! মেরিলিন মনরো বিখ্যাত গান গেয়েছিলেন, ডায়মন্ডস আর এ গার্লস বেস্ট ফ্রেন্ড (Diamonds are a girl’s best friend) তিনি বেচে থাকলে এখন হয়তো গাইতেন, ডায়মন্ডস আর এ সেভার্স ওরস্ট এনিমি (Diamonds are a saver's worst enemy)।

ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জন্য নয়
ফিরে আসি বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কেন আমেরিকা তথা পশ্চিম এত উদ্বিগ্ন সেই প্রশ্নে। বাংলাদেশে মিরপুর নিবাসী এক বন্ধুর জন্য পশ্চিমের বিভিন্ন সরকারপ্রধানসহ আমেরিকান নারী সিনেটর ও বিভিন্ন দেশের সুশীল সমাজ কেন এত উদ্বিগ্ন? এটা কি নিছক ড. ইউনূসের সঙ্গে পশ্চিমের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্বের ফল?

গত বছরে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মানবকল্যাণ সংস্থা রকফেলার ফাউন্ডেশন কর্তৃক ইনভেনশন ২০১১ ফোরাম শীর্ষক প্রথম পুরস্কার অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ড. ইউনূস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পল ফারমার, এজিটি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথি কচাবী, মেরি রবিনসন্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মেরি রবিনসন্স, রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রধান ড. জুডিথ রডিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বিশ্বমানবতার কল্যাণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রেসিডেন্ট কিনটনকে রকফেলার ফাউন্ডেশনের লাইফটাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।


এ অনুষ্ঠানে বিল কিনটন বলেন, আরকানসর গভর্নর থাকা অবস্থায় আমরা নিজেরাই ড. ইউনূসকে নিয়ে গিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করেছিলাম। সেটা এখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি জনপ্রিয় কর্মসূচি। আমি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এর যত ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন সেটা করেছি। এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় যে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবা নিজেও ড. ইউনূসের একজন অনুরাগী। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজেও এই কর্মসূচিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিল কিনটন বলেন, বিশ্বের দারিদ্র দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের কার্যকারিতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্ববাসী সব সময় স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতা থেকে কেউই তার নাম মুছতে পারবে না। অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণের পর সবার উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণেও কিনটন গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র ঋণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ঝঞ্ঝাবিুব্ধ এই বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দারিদ্র বিমোচনের কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় ড. ইউনূস বলেন, বর্তমান ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং উদ্ভাবনের সমন্বয় করতে হবে। কারণ এর প্রতিটা একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ জন্য বিশ্বের সৃজনশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি প্রণয়নের আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠান শেষে বিল কিনটন নিজেই এগিয়ে এসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় তারা কুশলাদি বিনিময় করেন। একই অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের প্রধান ড. ফজলে হাসান আবেদও আমন্ত্রিত ছিলেন। বিল কিনটন তার সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। (সূত্র : নিউজ ওয়ার্ল্ড ১৯ জুলাই ২০১২)।

বিল কিনটন ঠিকই বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি সমস্যাকে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দারিদ্র্য বিমোচনের কোনো বিকল্প নেই।

ভয়ঙ্কর ভোট ব্যাংক
ঢাকা ফোরকোজেস দি গ্রামীণ ব্র্যান্ড শিরোনামে ১৪ আগস্ট ২০১২-তে দি ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালে একটি নিবন্ধ লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। এখন তিনি উডরো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের সিনিয়র স্কলার পদে নিয়োজিত আছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন মাইলাম। তিনি লিখেছেন:

অনেক বাংলাদেশী বলেছেন, বর্তমান দুর্নীতিবাজ সরকারের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক গাছের নিচের ফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছেমতো এর বিশাল সম্পদ লুট করতে পারবে। তারা ব্যাংকটির নারী ঋণগ্রহীতাদের ফাদে ফেলে ঋণ মওকুফ কিংবা কমিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।

পশ্চিমা দেশগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক সম্মাননা দিলেও তারা গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। এখন ব্যাংকটিকে রক্ষায় বড্ড দেরি হয়ে গেছে। শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা থাকলেও তারা এখন এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এখন শেখ হাসিনা অন্য সরকারের কথা শুনে তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে আগ্রহী নন। আমার ধারণা, তারা এখন শুধু বাক্য বিনিময়ই করতে পারবে।

গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি পরামর্শ দিয়ে মাইলাম লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইওরোপিয়ান ইউনিয়নকে দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচি এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিতে হবে।

তবে এত দেরিতে দাতাদের দিয়ে এ কাজ করাতে গেলে তাতে বেশ বেগ পেতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ইস্যু নিয়ে চাপ দিলেও তার ফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া সম্ভব হবে না।
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিণতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, এ অবস্থায় আমাদের দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের পথপ্রদর্শক ব্যাংকটির বিলুপ্তি এবং এর স্বপ্নদ্রষ্টা প্রতিষ্ঠাতা ইউনূসের কোণঠাসা হয়ে পড়াকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পশ্চিমের প্রয়োজন ক্ষুদ্র ঋণ
আমেরিকা-ইওরোপ সোনা দিয়ে মোড়ানো মহাদেশ নয়। সেখানেও অনেক গরিব মানুষ আছে এবং সেখানে মন্দাবস্থার ফলে বেকারত্ব ও গরিব মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই সিরিজের তৃতীয় পর্বে আমি জানিয়েছি গ্রেট বৃটেনে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মানুষ ফুসে উঠেছে। পরিণতিতে যেসব ব্যাংকার ও সেলিবৃটিরা মোটা আয় করেন তাদের মোটা বিড়াল (ফ্যাট ক্যাট) টাইটেল দেয়া হচ্ছে এবং কেউ কেউ স্বেচ্ছায় বেতন কম নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বৃটিশদের মতো সুশৃঙ্খল বা ডিসিল্পিনড নয় গৃকরা। ইতিমধ্যে গৃসে বড় বড় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে গিয়েছে ও সরকারের পতন ঘটেছে। ইটালি, স্পেন, পর্টুগাল, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ডে মানুষের অসন্তোষ গভীরতর হচ্ছে।

পশ্চিমের এই ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বন্ধ করার জন্য সেখানেও ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের প্রয়োজন। আর সেজন্যই অর্থাৎ পশ্চিমের স্বার্থেই ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে বাচিয়ে রাখা দরকার। আমেরিকায় গ্রামীণ আমেরিকাসহ বিশ্বের ৫৫টির বেশি দেশে গ্রামীণ ব্যাংক মডেলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য সেসব দেশকে অনুপ্রাণিত করছে।

এখন বাংলাদেশেই যদি গ্রামীণ ব্যাংক ব্যর্থ হয়ে যায় এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস যদি নিন্দিত ধিকৃত হন তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। অনুপ্রাণিত হবার বদলে তারা হতাশাগ্রস্ত হতে পারে।

৭ আগস্ট ২০১২-তে ড. ইউনূসের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম হিলারি ও বিল কিনটনের সাথে তার বন্ধুত্বের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিল? ড. ইউনূসকে বলেছিলাম, অনেকের ধারণা আরকানসতে তারা একসাথে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সময় থেকে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার সূচনা।

ড. ইউনূস জানান, তারা একসাথে পড়াশোনা করেননি। আমেরিকায় প্রতি বছর রাজধানী ওয়াশিংটনে আমেরিকার পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নরদের সম্মেলন হয়। ১৯৮৬-তে আমেরিকার সবচেয়ে গরিব রাজ্য আরকানস-র গভর্নর চিলেন তরুণ বিল কিনটন। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সাফল্য বিষয়ে পরিচিত ছিলেন শিকাগোর সাউথ শোর ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা রন মেরি। হিলারি ও বিল কিনটনের সাথে ড. ইউনূসের পরিচয় হয় ওয়াশিংটনে রন মেরির আনুকূল্যে। গ্রামীণ ব্যাংকের কথা জেনে কিনটন দম্পতি বলেন, গভর্নরদের সম্মেলন শেষে তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান এবং ড. ইউনূসকে তারা আরকানস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী লিটল রক-এ তখনই যেতে অনুরোধ করেন। ড. ইউনূস তাই করেন।

বলা বাহুল্য, সেই সময়ে বিল কিনটন জানতেন না যে তিনি পরবর্তীকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন। ড. ইউনূস জানতেন না যে তিনি নোবেল প্রাইজ পাবেন। এবং হিলারি কিনটন জানতেন না যে তিনি আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) হবেন। এখন আবার তারা যখন মিলিত হন তখন নিশ্চয়ই তাদের সাফল্য (ও ব্যর্থতাও) বিষয়ে অন্তরঙ্গ আলোচনা করেন এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত সমস্যা সমাধানের পথ খোজেন। আর তারই ফলে ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় বারিধারায় আমেরিকান দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ওপর অব্যাহত চাপ আছে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে বাচিয়ে রাখার জন্য।

তবে আগেই বলেছি এর কারণ ব্যক্তিগত নয়। এর কারণ পশ্চিমের পুজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সহায়ক রূপে সেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাচিয়ে রাখা।

বাংলাদেশের নিহত সম্ভাবনা
আর সেখানেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন। বৃটেনে টেসকো ব্যাংক, সেইনসবেরিজ ব্যাংক, আসদা মানি ও এম অ্যান্ড এস মানির পাশাপাশি গ্রামীণ ইউকে জন্ম নিতে পারত এবং সফল হতে পারত। ঠিক তেমনি গ্রামীণ গৃস, গ্রামীণ ইটালি, গ্রামীণ স্পেন, গ্রামীণ পর্টুগাল প্রভৃতি হতে পারত। আর এসব প্রতিষ্ঠানের টর্চ লাইট রূপে বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারত। মিরপুর হতে পারত বিশ্ব মাইক্রো ব্যাংকিংয়ের মিনিসেন্টার। বাংলাদেশে শত শত শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থান হতে পারত। গ্রামীণ বাংলাদেশ হতে পারত বিশ্বের একটা ফোকাল পয়েন্ট। নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্টৃট ও লন্ডনের সিটি ও ক্যানারি হোয়ার্ফ-এ বিশ্ব বিগ ফাইনান্সের কর্মকাণ্ড চলছে। কিন্তু বিশ্ব স্মল ফাইনান্সের কর্মকাণ্ড চলতে পারত মিরপুর থেকে। নকিয়া একাই যেমন ফিনল্যান্ডের মতো একটি ছোট দেশকে অর্থনৈতিকভাবে বিশালভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে Ñ ঠিক তেমনি গ্রামীণ ব্যাংক একাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে বিরাটভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। পদ্মা সেতু, ফাইওভার, ফোর লেইন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেল প্রভৃতির জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড বাংলাদেশেই তখন গড়াগড়ি খেত।

এটা অসম্ভব ছিল না।

আশির দশকের সূচনায় পাকিস্তানের এন্টারপ্রেনিউয়ার আগা হাসান আবেদি-র ভিশন ও নেতৃত্বের ফলে বিসিসিআই ব্যাংক পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকা, বৃটেন ও জাপানসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে।

স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের এককালীন গভর্নর আবদুর রশিদ ছিলেন বাঙালি। তাকে বিসিসিআই খুব উচু পদে বসিয়েছিল। একেএন আহমেদসহ বহু বাঙালি এই ব্যাংকের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শাখায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই ধরনের বহু সুযোগ আজকের বাঙালি বেকার যুবকরা পেত যদি ইওরোপে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুপ্রবেশকে শেখ হাসিনা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি সেটা করেননি। বরং আন্তর্জাতিক টিভি ইন্টারভিউতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাকে রক্তচোষা বলেছেন নাম না নিয়ে।

শেখ হাসিনা বোঝেননি তিনি বাংলাদেশের কত বড় সম্ভাবনাকে খুন করেছেন।


শেখ হাসিনা বোঝেননি আগামী নির্বাচনে জয়লাভের ব্যক্তি-অভিলাষে অথবা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থে (বিল কিনটনের ভাষায়) তিনি বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে শুধু বঞ্চিতই নয়, কত গভীর হতাশা ও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন।

শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, ড. ইউনূসকে বিদায়ের পর গ্রামীণ ব্যাংক আরো ভালো চলছে। কে তার কথা বিশ্বাস করবে? ইউনূসের অবর্তমানে কত দিন গ্রামীণ ব্যাংক ভালো চলবে? বিজ্ঞাপন দিয়ে বিদেশ থেকে যোগ্য এমডি এনে গ্রামীণ ব্যাংক চালানোর ঘোষণা তিনি যেদিন দিয়েছেন সেই দিনই রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার কুৎসিত খবরটি প্রকাশিত হয়। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স কি? সেসব ব্যাংকের জন্য বিদেশ থেকে এমডি আনা হবে কি? স্টক এক্সচেঞ্জে ধস, এমএলএম ব্যবসায়ে প্রতারণা, সোনালী ব্যাংকে চুরি, প্রভৃতির দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এড়াতে পারেন না। বস্তুত বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কারোই আমার পাড়ার বাবুল স্টোর্সের ছোট ব্যবসা চালানোর মতো অভিজ্ঞতা নেই। বাবুল স্টোর্সের মালিক অথবা যে ফেরিওয়ালা মাথায় ঝুড়ি বহন করে ফল ও সবজি বিক্রি করেন তাদেরকে প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের সঠিক ফোরকাস্ট ও অ্যাকাউন্টস করতে হয়। চাকরিজীবন জুড়ে যাদের মাসের শেষে বেতন পাওয়া নিশ্চিত, তারা কখনোই বিজনেস ও ইনডাসটৃর প্র্যাকটিকালিটিজ ও ঝুকি (বিক্রি না হওয়ার ঝুকি, হরতালের ঝুকি, চাদাবাজদের ঝুকি, বিদ্যুৎ গ্যাস পানি না থাকার ঝুকি) বুঝতে পারেন না বলেই বাংলাদেশে এখন গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গভীরতর অর্থনৈতিক সংকট।

সোনালী ব্যাংক ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের এমডি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর এবং অর্থমন্ত্রীর পদের জন্য বিদেশী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়া হবে কি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো উত্তরটা জানেন।
কিন্তু তিনি সেটা বলবেন না।
তিনি এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে।
তিনি এখন ডেসপারেট।
তাকে সাধারণ নির্বাচনে জিততেই হবে।
তাই তাকে কানাডায় এসএনসি লাভালিনের আসন্ন বিচারকে সাজানো প্রতিপন্ন করতে হবে।
তাই ইউনূসকে ‘কানাডিয়ান ষড়যন্ত্র’-এর হোতা রূপে স্বদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তাই ড. ইউনূস-বিরোধী আওয়ামী ক্যামপেইনকে আরো বেগবান করতে হবে।
ড. ইউনূসের চূড়ান্ত অপমান না হওয়া পর্যন্ত.. .. ..
অথবা.. .. .. শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত।

আসন্ন ঈদে ধর্মভীরু ব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কার জন্য তারা দোয়া ইউনূস পড়বেন?
বিপন্ন ইউনূসের জন্য?

নাকি চিরস্থায়ী ক্ষমতাকামী শেখ হাসিনার জন্য?

১৫ আগস্ট ২০১২


শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি অ্যাংকর।

No comments

Powered by Blogger.