কড়া নাড়ছে পেন্টাগন, লক্ষ্য চীন by শান্তনু দে

আটলান্টিকে আধিপত্য অটুট রেখে এবারে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর। ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র -এখন প্রশান্ত মহাসাগরেরও শক্তি। এবং আমরা এখানে থাকতে এসেছি।’

বলেছেন প্রথম মার্কিন ‘প্যাসিফিক’ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। গত বছর নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে। সেদিন তিনি ঘোষণা করেন ডারউইনে ২৫০০ মার্কিন সেনা মোতায়েনের কথা। ডারউইন মানে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। ওবামা জানিয়েছেন, এই সাগরে আরও আসবে মার্কিন রণতরী, মার্কিন যুদ্ধবিমান। সেইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারে আরও সুযোগ পাবে পেন্টাগন। হবে আরও যৌথ মহড়া। অস্ট্রেলিয়ায় মজুত করা হবে আরও মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম।
শেষে জানুয়ারিতে পেন্টাগনে দাঁড়িয়ে ওবামা ঘোষণা করেন নতুন মার্কিন সামরিক ডকট্রিন-‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব-নেতৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা : একুশ শতকের প্রতিরক্ষা প্রশ্নে অগ্রাধিকারসমূহ’।

‘আমি অস্ট্রেলিয়াতেই যা স্পষ্ট করে বলে এসেছি’, ওবামা বলেছেন, ‘আমরা আমাদের উপস্থিতি আরও জোরদার করছি এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, আর এক্ষেত্রে বাজেটের বাধা এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের জন্য কখনও বাধা হবে না।’

আর এ থেকেই স্পষ্ট, ওয়াশিংটনের মনোযোগ এখন চীন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মার্কিন সামরিক নীতিতে রীতিমতো ঐতিহাসিক মোড়। বরাবরের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে যেমন থাকবে মার্কিন সেনার উপস্থিতি, তেমনই নতুন এই নীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরকে।

ইরাক এবং আফগান যুদ্ধই প্রমাণ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে তার স্থির দৃষ্টি কখনোই সরিয়ে নেয়নি। মার্কিন বিমানবাহিনীর এফ-২২ যুদ্ধবিমানগুলির প্রায় অর্ধেকই মোতায়েন করা আছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ইয়াঙ্কি বিমানবাহী দু’টি রণতরী সবসময়ই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে এই অঞ্চলে। জাপানে স্থায়ীভাবেই মোতায়েন রয়েছে অন্তত ৪০ হাজার মার্কিন সেনা। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৮,০০০। ২০০৬সালে পেন্টাগন এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ করে ৬টি বিমানবাহী রণতরীসহ মার্কিন সাবমেরিনের ৬০ শতাংশ। চীনের তুমুল আপত্তি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে করেছে ৬০০ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনাবেচার চুক্তি।

১৬০ বছর আগে কার্ল মার্কসের নিশ্চিত ভবিষৎবাণী ছিল : প্রশান্ত মহাসাগর একদিন হবে ‘বাণিজ্যের মহার্ঘ জলপথ’, যা নেবে ‘বিশ্ব বাণিজ্যের ভরকেন্দ্রের’ ভূমিকা। ঠিক যে ভূমিকা তার শতাব্দীতে নিয়েছিল অতলান্তিক, রোম সাম্রাজ্যের সময় ভূমধ্য সাগর।

মার্কসের এই মন্তব্য থেকেই মেলে বিশ্বের এই রাজনৈতিক অর্থনীতির তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের নির্যাস, যা আমরা দেখছি এই একুশ শতকে, প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিকাশ দেখে। এই মহাসাগরের ওপর দিয়েই এখন ৫ লক্ষ কোটি ডলারের বাণিজ্য চলে ফি বছর। এক সময়ের ‘বিপজ্জনক এলাকা’ এখন বিশ্বের জাহাজ চলাচলের ব্যস্ততম পথ। দুনিয়ার কাছে ‘নিউ পারশিয়ান গালফ’ এবং ‘হাইড্রোকার্বনস এলদোরাদো’।

গোটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। ওয়াশিংটন চায় তার দাবিপূরণ করার মতো অনুগত সরকার বসানোর ক্ষমতা, বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে বেসরকারীকরণ ও বিনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। সর্বত্র অবাধ ‘মুক্ত বাজার’। থাকবে এমন কর্তৃত্ব যাতে কোনও সার্বভৌম সরকার তার নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বিকাশমান অর্থনীতি, রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজিক তাৎপর্যকে দু’দশক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছিল বুশ প্রশাসন। কিন্তু, ৯/১১’র পর মধ্যপ্রাচ্যের অফুরন্ত সম্পদ ও রাজনৈতিক অভিমুখকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে হোয়াইট হাউসের অগ্রাধিকারে চলে আসে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’।

এখন ওবামা প্রশাসন ফের মুখ ফিরিয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর, এশিয়ার দিকে। সেইসঙ্গে যোগ করেছে ভারত মহাসাগরকেও। নতুন ডকট্রিনে মার্কিন সামরিক বরাদ্দ ছাঁটাইয়ে যত না গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দুনিয়াজোড়া আধিপত্যকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে পেন্টাগনের অগ্রাধিকারগুলিকে পুনর্বিন্যাশে।

পেন্টাগনের স্ট্র্যাটেজিক রিপোর্টে বলা হয়েছে: ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা স্বার্থসমূহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত বলয়টির ঘটনাবলীর সঙ্গে যুক্ত।’

সেকারণেই মার্কিন নতুন ডকট্রিন, ‘এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন করে ভারসাম্য রক্ষার অভিমুখে এগনো জরুরি।’

নয়া সামরিক নীতি প্রকাশ করে ওবামা জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা বাজেট কাটছাঁট করলেও এখনও তা বিশ্বের পরবর্তী চোদ্দটি বৃহত্তম সামরিক শক্তির মিলিত বাজেটের চেয়ে বেশি। তাছাড়া, ‘প্রতিরক্ষা বাজেটে বিকাশের হার একটু কম হলেও, ঘটনা হলো: এখনও তা বেড়েই চলবে।’

এবং এই সামরিক বরাদ্দে ছাঁটাই সত্ত্বেও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাড়ানো হচ্ছে মার্কিন সেনা।

মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব লিওন পানেত্তা জানিয়েছেন, ‘মার্কিন জয়েন্ট ফোর্স হবে আরও ছোট, আরও মেদহীন।’ আগামী পাঁচ বছরে সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৫ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে কমিয়ে ৪ লক্ষ ৯০ হাজার করা হবে। পাশাপাশি, নৌ বাহিনীর সদস্য কুড়ি হাজার কমিয়ে ২ লক্ষ ২০ হাজার থেকে করা হবে ১ লক্ষ ৮২ হাজার। ‘তবে এটি হবে আরও গতিশীল, আরও নমনীয়; আরও ক্ষিপ্রতা নিয়ে প্রস্তুত থাকবে সেনাবাহিনী মোতায়েনে, হবে সৃজনশীল, প্রযুক্তিতে আরও উন্নত।’

এবং তা কখনই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মূল্যে নয়।

পানেত্তার কথায়, এশিয়ায় শক্তি বৃদ্ধিই হবে আগামী বছরগুলিতে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

সঙ্গে অন্যান্য লক্ষ্যগুলি হলো: সাইবার যুদ্ধ, স্পেশাল অপারেশন এবং সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ।

পেন্টাগন প্রকাশিত স্ট্র্যাটেজিক রিপোর্টে গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করা হয়েছে : জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী একটি সামরিক জোট গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা। একইসঙ্গে চীন-বিরোধী এই সামরিক জোটে ভারত এবং ভিয়েতনামকে যুক্ত করার চেষ্টাও যে অব্যাহত থাকবে সেকথা।

স্ট্র্যাটেজিক রিপোর্টে ভারতকে ‘আঞ্চলিক নঙ্গর’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘বৃহত্তর ভারত মহাসাগর অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে পারে’- ভারত। গত কয়েক বছর ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে।

পাশাপাশি, ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ বাহিনী ‘কম্পাস’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা ইতোমধেই তুলে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন এবং অস্ট্রেলিয়া বহুদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্র দেশ। চীনের প্রতিবেশী মিয়ানমারও পশ্চিমের সামরিক কৌশলের সঙ্গে যোগ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরকে এখন ‘আমেরিকান হ্রদ’ হিসেবে দেখতে চায়।

একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথগুলি দিয়ে তার যুদ্ধজাহাজগুলির চলাচল নিশ্চিত করতে। তা সে হরমুজ কিংবা মালাক্কা যে কোনও প্রণালী দিয়েই হোক না কেন। পেন্টাগনের নতুন এই সামরিক নীতিতে পণ্যের অবাধ চলাচল এবং বিশ্বের সর্বত্র সেসব পণ্যের পৌঁছানো নিশ্চিত করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন স্ট্র্যাটেজিক রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই ওবামা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সোসাইটি’ নামের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে একটি সহযোগিতামূলক বলয় তৈরি করার জন্যে ওয়াশিংটনের প্রতি আহবান জানিয়েছে। তাদের কথিত উদ্দেশ্য যথারীতি, ওই অঞ্চলের নৌচলাচল এবং ছোট রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা রক্ষা করা।

মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিনটন আগেই চীনকে মোকাবিলা করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ।’ এক ধাপ এগিয়ে হিলারি দাবি করেন, চীন সাগর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে বিশ্ব অর্থনৈতিক বিকাশ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। মার্কিন বিদেশ দপ্তরের সহকারী সচিব উইলিয়াম জেমস নভেম্বরে বলেন, ‘আগামী বহু দশকের জন্য বহু ক্ষেত্রেই বৃহত্তর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল হতে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে গতিশীল ও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ।’

ওই অঞ্চলের ছোট প্রতিবেশীগুলির সঙ্গে চীনের যে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে সেইসব বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমান আগ্রহী। ওয়াশিংটনের নতুন অবস্থানের কারণে দক্ষিণ চীন-সাগর বিবাদের শুধু আন্তর্জাতিকীকরণ হয়নি, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা নতুন ক্ষেত্রও উন্মুক্ত হয়েছে।

ক্লিন্টনের মন্তব্যের পর পরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলির সহযোগী পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস এক সম্পাদকীয়তে লেখে: ‘চীনের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনাকে কখনও দুর্বল অবস্থান বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না… এবং চীন তার প্রধান স্বার্থ সামরিক উপায়ে রক্ষা করার জন্য তার অধিকার কখনও ছেড়ে দেবে না।’

মার্কিন রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে: ‘দীর্ঘ সময় ধরেই আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের মধ্যে রয়েছে মার্কিন অর্থনীতি ও আমাদের নিরাপত্তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা।’

মার্কিন স্ট্র্যাটেজি হলো: প্রথমে চীনের সামরিক বরাদ্দকে (যদিও চীনের সামরিক বরাদ্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশভাগের একভাগেরও কম) ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার, সামরিক ঘাঁটি দিয়ে চীনকে ঘিরে ফেলা, চীন-বিরোধী জোট গড়ে তোলা এবং চীনের কাছে থিয়েটার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন, যাতে চীনের পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিরোধ করা যায়।

প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাংশের এই সাগর চীন, অস্ট্রেলেশীয় দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে অনেককাল ধরেই বিতর্ক ও সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র। পশ্চিমে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণে ফিলিপিনস, ব্রুনেই, উত্তরে তাইওয়ান এবং চীন সব ক’টি দেশের বাণিজ্যের তীব্র প্রবাহ এই সমুদ্র জুড়ে। ১০ লক্ষ বর্গমাইলের চেয়েও বেশি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত দক্ষিণ চীন সাগর যুক্ত করেছে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমুদ্রপথ এই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত। যার নিচে রয়েছে সম্ভাবনাময় তেল ও গ্যাসের অপার মজুত ভান্ডার। এখনও যা অনাহরিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক সহযোগীরা যদি এই অঞ্চলের দখল নিতে পারে তবে নৌপথে চীনকে আটকে দেওয়া সহজ।

চীনের আমদানি করা তেল, গ্যাসের অন্তত ৮৫শতাংশ আসে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে। মারাত্মক স্পর্শকাতর মালাক্কা প্রণালী হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর চীনের বন্দরে। আর মালাক্কা প্রণালীর এক প্রান্তে সিঙ্গাপুরের চেন্তি নৌঘাঁটিতে মার্কিন নৌ-সেনার উপস্থিতি। অন্য প্রান্তে মার্কিন নৌ-বহর (যা ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া থেকে পরিচালিত হয়)। তাছাড়া, চীন বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে মধ্য এশিয়া এবং সাইবেরিয়া থেকে আসা পাইপলাইনের জন্য। আফ্রিকা থেকে বাড়ছে তেল আমদানি। চীনের শীর্ষ তিনটি তেল, গ্যাসের উৎসের দু’টি হলো সৌদি আরব এবং ইরান (অন্যটি অ্যাঙ্গোলা)। দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি শিপিং কনটেইনার ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে। মধ্য প্রাচ্য থেকে প্রশান্ত মহাসাগর-বিশ্ব তেল বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই প্রবাহিত হয় ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে।

ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে নিজেদের আত্মরক্ষা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা চীনের জন্য তাই ভীষণই জরুরী। চীনের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করতে মার্কিন নৌবাহিনীর ওপর নির্ভরতা হবে আত্মঘাতী।

‘এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গঠনমূলক ভূমিকাকে স্বাগত, কিন্তু যুদ্ধোন্মাদনাকে নয়।’ শিরোনাম চীনের সরকারী সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ায়। ওই নিবন্ধে চীন বলেছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবিবেচকের মতো এই অঞ্চলে সামরিকীকরণ করছে। এটা অনেকটাই চীনের দোকানে ষাঁড় ঢুকে পড়ার মতো। যা এই অঞ্চলের স্থায়ীত্বকে মজবুত করার বদলে তাকে বিপদের মুখে দাঁড় করাবে।’

চায়না ডেইলি’র শিরোনাম: আঞ্চলিক ভূমিকায় কর্তৃত্ব নিতে ‘উত্তেজনায় জ্বালানি জোগাচ্ছে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনকে ‘পেশিশক্তি ব্যবহারে সংযত হওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছে চীন।

পিপলস লিবারেশন আর্মির দৈনিকে প্রকাশিত এক লেখায় চীনের শীর্ষস্তরের সামরিক কর্তা মেজর জেনারেল লুইয়ান সরাসরি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে স্থির করেছে। ‘চারদিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রধান পাঁচ সামরিক সহযোগীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সে এই পাঁচটি দেশে তার নিজস্ব পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিও গড়ে তুলছে। তাছাড়া চীনকে ঘিরে থাকা অন্যান্য দেশেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে।’

ন্যাটো’র এশীয় সংস্করণ চায় ওয়াশিংটন।

শিরোনাম চীন সরকারের দৈনিক ‘চায়না ডেইলি’ পত্রিকায়। আজ নয়, কয়েক বছর আগেই।

মিয়ানমার সামরিক সরকারের সঙ্গে হঠাৎই সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে আমেরিকা। অর্ধশতক ধরে মিয়ানমার সামরিক জুন্টার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল ওয়াশিংটন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন লক্ষ্যস্থল বার্মা। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে হিলারি ক্লিনটনের মিয়ানমা সফরের পর থেকেই এই অর্থনৈতিক নিষেধজ্ঞাসমূহের অনেকটাই তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত ৫০ বছরে হিলারির এই সফরই ছিল শীর্ষস্তরের কোনও মার্কিন কর্তার প্রথম মিয়ানমার সফর। চীনের সঙ্গে জল ও স্থল সীমান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ানভুক্ত দেশগুলিকে সমর্থন জানাবে, গত বছর ওবামার এই ঘোষণার পর পরই ক্লিনটনের মিয়ানমার সফর।

এই মুহূর্তে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স মোতায়েন রয়েছে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে। ভারত ছাড়াও রয়েছে নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপে। ফাঁস করে দিয়েছেন মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড। তাও আবার মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া ও আমেরিকায় জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্র উপকূলের গুরুত্ব এবং এর কৌশলগত অবস্থান তুলে ধরে উইলার্ড কংগ্রেসকে জানান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের কাছে ক্রমশ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

আমেরিকা এখন বস্তুতই ‘প্যাসিফিক নেশন’।


শান্তনু দে: কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.