বাংলাদেশের জন্য তাদের বড় দুঃখ হয় by মুনতাসীর মামুন

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) ঐ সময় যাঁরা তথ্যসংগ্রহ ও সঙ্কলন করেছিলেন তাঁরা ছিলেন অতি তরুণ। অনেকে কিশোর বয়সী। গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটে অনেক তরুণ আইনজীবী ছিলেন বটে তবে তাঁরা তেমন সক্রিয় ছিলেন না। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ের তরুণরাই ছিলেন গণতদন্ত কমিশনের প্রাণশক্তি।


সুফিয়া কামাল কমিশনের পক্ষে দাবি করে বলেছিলেন “গণতদন্ত কমিশন ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম (ট্রাইব্যুনাল) এক্ট অনুযায়ী এই বিচার অনুষ্ঠানের জন্য সুপারিশ করছে। এ প্রসঙ্গে কমিশন আরও সুপারিশ করছে যে ইতোপূর্বে বাতিলকৃত এতদসংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক আইনসমূহ পুনরুজ্জীবিত করে সেই সব আইনের অধীনে অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।”
একই দিনের প্রায় [ ১১.৯.১২] প্রতিটি পত্রিকায় শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য সম্পর্কেও প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। শাহরিয়ার বলেছেন, “রাজাকার সদস্যরা জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্র বহন করত।” এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে।
“অধ্যাপক গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী এবং এ্যাডভোকেট আফজউদ্দিন এদের স্বাক্ষরিত কোন রাজাকার পরিচয়পত্র উদ্ধার হয়েছিল কি?
উত্তর : আমার সংগ্রহে নেই, তবে আমার ছবিতে মতিউর রহমান নিজামী স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্র আছে।” [জনকণ্ঠ ১১.৯.২০১২]
এর অর্থ কি এই যে, যেহেতু গোলাম আযম স্বাক্ষরিত কোন পরিচয়পত্র নেই, সেহেতু রাজাকারদের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। এ প্রসঙ্গ নিয়ে ১০ তারিখ রাতে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল [টিভি সংবাদ দেখার পর] আমরা অনেকে এ প্রসঙ্গে লিখেছি কারণ বিষয়টি সত্য। কিন্তু এই সত্য প্রমাণে যে আমাদের জামায়াত নেতাদের স্বাক্ষরিত আইডেনটিটি কার্ডও সংগ্রহে রাখতে হবে তা তো মনে হয়নি।
১১ তারিখ সকালে আমার এক বন্ধু আমার লেখা একটি পেপারের কাটিং নিয়ে এলেন। লেখাটির নাম ‘শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর : উৎসের সন্ধানে।’ আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে ছাপা যা আমার মনে ছিল না। বন্ধুটি এ সব কাটিং সংগ্রহ করেন তাই হয়ত তাঁর হঠাৎ মনে হয়েছে লেখাটি সম্পর্কে সেখানে পাঁচটি ছবি ছাপা হয়েছে। এবং ছাপা দুটি ছবি আইডেনটিটি কার্ডের। এতে আছে গোলাম আযম ও খাজা খয়েরউদ্দিনের স্বাক্ষর। ১৩ বছর আগে প্রকাশিত সেই নিবন্ধের খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করছি ছবিসহ “শান্তি কমিটির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে। লুটতরাজ, ধর্ষণ করেছে। হত্যায় সহায়তা করেছে, হত্যাও করেছে। এরাও যুদ্ধাপরাধী শান্তি কমিটির সমর্থক।
গোলাম আযম নিজেও তা স্বীকার করেছেন ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এক বক্তৃতার মাধ্যমে। “দেশের সাম্প্রতিক সঙ্কট [মুক্তিযুদ্ধ] ও দুষ্কৃতকারীদের [মুক্তিযোদ্ধা] ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে যেসব পাকিস্তানী প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জড়িত। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করে। ... তাই জামায়াতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখ-তা রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকার ও আলবদরে লোক পাঠিয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মনে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছে।...”
গোলাম আযম এখনও তাই মনে করেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার স্টাডি সার্কেল গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। “(চ) জটিল রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা : ’৭১-এ বাংলাদেশের জন্ম পদ্ধতিতে জামায়াতের ভূমিকা : প্রতিকার : বলিষ্ঠ বক্তব্য পলাশী থেকে বাংলাদেশ, আমার দেশ বাংলাদেশ আমাদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে স্বীধীনতার রক্ষক জনগণ কাদেরকে মনে করে?
’৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট কি ছিল? সারা পাকিস্তানে রাজনীতি করার অযোগ্য যারা তারাই ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা আলাদা হয় না।” এর অর্থ পাঠকদের নিশ্চয় বলতে হবে না। সুতরাং জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা রাজনীতি করছে তারা পাকিস্তানী কালচার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করছে তা বললে কি খুব ভুল হবে? আলবদরদের কথা বেশি বলার দরকার নেই। কিন্তু আলবদরদেরও নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের নাম ছাড়া অন্যদের নামের তালিকা পাওয়া যায়নি। তাদের কোন ছবিও পাওয়া যায়নি। তাই অনেক সময় বলা হয়, আলবদররা যে ছিল এর প্রমাণ কি?
সম্প্রতি জনকণ্ঠে ‘রাজাকারের মন’ বেরুবার পর অনেকে আমার সঙ্গে চিঠি মারফত যোগাযোগ করেছেন, বইপত্র পাঠিয়েছেন রাজাকারদের বিষয়ে। একজন পাঠক কিছু ছবি পাঠিয়েছেন। খুব সম্ভব তিনি কোন পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর পাঠানো ছবির মধ্যে আছে আলবদরদের একটি গ্রুপ ছবি, শান্তি কমিটির ও আলবদরদের কয়েকজনের ছবি। এদের নাম বা ছবি কখনও ছাপা হয়েছে বলে মনে হয় না। ১৯৭২ সালে পত্রিকায় অনেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কার্যকলাপের প্রমাণপত্র, ছবি দিয়ে গেছেন। যার কিছু ছাপা হয়েছে কিছু হয়নি। ‘রাজাকারের মন’-এ তথ্যাদি দিয়ে উল্লেখ করেছিলাম, আলবদর, শান্তি কমিটি বা এক কথায় রাজাকারদের একটা বড় অংশ ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। নিচের ছবি ও বিবরণ তা প্রমাণ করে। এবং প্রমাণ করে গোলাম আযম কিভাবে এগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
২.
গ্রুপ ছবিটি আলীয়া মাদ্রাসার আলবদর বাহিনী ইউনিটের। প্রথম সারির ডান দিক থেকে দ্বিতীয় : বদর বাহিনীর কমান্ডার সৈয়দ নূরুল হক। এই সারির আরও দু’জনকে শনাক্ত করা গেছে। এরা হলো বাঁ দিক থেকে প্রথম সাঈদ আহমদ, দ্বিতীয় জন হেলাল উদ্দিন। দ্বিতীয় সারির বাঁ দিক থেকে তৃতীয় ব্যক্তিকে শনাক্ত করা গেছে। তার নাম আলতাদুর রহমান (চশমা চোখে) মধ্য সারির বাঁ দিক থেকে প্রথম ব্যক্তি সাব্বির আহমদ, দ্বিতীয় জন ওয়াহিদুল হক। শেষ সারির ডান দিক থেকে প্রথম জন আব্দুল্লাহ, বাঁ দিক থেকে তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম ব্যক্তি হচ্ছে জোবায়ের, শাদিকুল্লাহ খান ও হাবিবুর রহমান।
বদর বাহিনীর আরেকজন সদস্যের আইডেনটিটি কার্ড পাওয়া গেছে। সে আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র, নাম আবু নাসির মোহাম্মদ আব্বাস পাটোয়ারী। শুধু ছবি পাওয়া গেছে আরও দু’জনের আইডেনটিটি কার্ড থেকে ছবি দুটি খুলে নেয়া হয়েছে। এরা আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র, নাম গাজী ইদ্রিস ও গিয়াস উদ্দিন। শান্তি কমিটির দু’জনের পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। এরা দু’জন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য। একজনের নাম আশরাফ আলী খান। পিতার নাম এ আজিজ খান, ঠিকানা ১৩৭ আগা সাদেক রোড, থানা লালবাগ, ঢাকা। খাজা খয়েরউদ্দীন স্বাক্ষরিত এ কার্ডে লেখা আছে, “ঞযব সবসনবৎ সধু শরহফষু ধভভড়ৎফবফ ধষষ ংড়ৎঃ ড়ভ পড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ নু ঃযব ধঁঃযড়ৎরঃু ঃড় সধরহঃধরহ ঢ়বধপব ধং ধহফ যিবহ হবপবংংধৎু.”
গোলাম আযম স্বাক্ষরিত আরেকটি কার্ড হলো মোঃ আবদুর রহমান, গ্রাম ও পো: কানু, দাসকাঠি, পুলিশ স্টেশন : রাজাপুর, জেলা-বরিশাল, পিতা আলহাজ আজহার উদ্দিন। কার্ডে লেখা আছেÑ ঞযব যড়ষফবৎ ড়ভ ঃযরং পধৎফ রং ধ ঃৎঁব চধশরংঃধহর. ঐব রং ড়িৎশরহম ভড়ৎ ংড়ষরফধৎরঃু ড়ভ চধশরংঃধহ. ঐব যধফ ধষধিুং নববহ ভরমযঃরহম ধমধরহংঃ ধহঃর-ংঃধঃব ভড়ৎপবং. ঐব রং ফবঢ়বহফধনষব. কার্ড দুটির ভাষা লক্ষ্য করুন; পাকিস্তানত্ব প্রচারে গোলাম আযমের ভাষা অত্যন্ত জোরাল। এদের অনেকে হয়ত আপনাদের আশপাশে আছে। এদের কাউকে চিনে থাকলে তাদের সম্পর্কে তথ্য জনকণ্ঠে প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
‘আলবদর ১৯৭১’-এর উপসংহারে লিখেছিলাম সরকারী প্রস্তাবিত আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ে “মোগারেসিনের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের উপাধি হবে ‘গ্র্যান্ড মুফতি।’ আমি যখন বিদেশে ছিলাম তখন সরকার থেকে জানানো হয়েছে, উপাচার্যের পদবি উপাচার্যই হবে, গ্র্যান্ড মুফতি নয়।
সুতরাং, আমার বক্তব্য এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। আগেই উল্লেখ করেছি যেহেতু কপি দিয়ে আমি দলে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে তাই এই বাক্যটি প্রত্যাহার করার কথা আর মনে ছিল না। সে জন্য দুঃখিত।
‘আলবদর ১৯৭১’ শেষ কিস্তি পড়ে আমার এক সহকর্মী আলাপ করতে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালের আলবদররা যে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি আলাপ করছিলেন। এসব তথ্য তাঁর মনে হয়েছে একেবারে নতুন। মুক্তিযুদ্ধের পর পর তিনি শেরপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন, যেখানে আলবদর কামরান সম্পর্কে শুনেছিলেন যে কামরান আলবদরের একজন প্রতিষ্ঠাতা ও বহু দুষ্কর্মের হোতা। তার খোঁজ পাওয়া যায়নি মুক্তিযুদ্ধের পর।
আমার সহকর্মী জানালেন, বছর দুয়েক আগে তিনি মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। সেখানে এক অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়, যিনি বাংলায় কথা বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক জানান, ১৯৭২ সালে ভাগ্য বিপর্যয়ের পর তিনি মালয়েশিয়া চলে আসেন। আমার সহকর্মী তখনও ব্যাপারটা বোঝেননি। আরও কিছুক্ষণ আলাপের পর জানা গেল সেই অধ্যাপকই হলেন ১৯৭১ সালের ভয় উদ্রেককারী কামরান, মালয়েশিয়ায় অধ্যাপনা করছেন এখন কামরান। বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা মন্তব্য করে জানান, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর তারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এবং দেশ ভালই চলছিল। শেখ হাসিনা এসে বাংলাদেশকে আবার পিছিয়ে নিচ্ছেন। আমার সহকর্মী তাকে জানালেন। কিন্তু পাকিস্তানও তো এখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। হয়ত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এ কথার উত্তর না দিয়ে কামরান জানান, ‘বাংলাদেশের জন্য খুব দুঃখ হয়।’
রাজাকার আলবদরদের মন এ রকমই। তাদের একমাত্র মক্কা। মক্কাও নয় তা’ হলো পাকিস্তান। এ এক অদ্ভুত বিকৃত মনোভাব, অবসেসন। তারা এখনও পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিএনপি তাদের লক্ষ্য পূরণের প্রধান মিত্র। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যতই তাদের তোষণের চেষ্টা করুক বিভিন্নভাবে তারা শেখ হাসিনার মৃত্যুই কামনা করে। আলবদর-রাজাকারদের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত বিস্তৃত। তারা বিভিন্ন দেশে ভালভাবে অবস্থান করছে। এবং জামায়াত নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। সেটিও অনুমান করে নেয়া যায়। তারা আবারও প্রস্তুতি নিচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়ার। শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার কি তা বিশ্বাস করে? যদি করতেন বা করত তাহলে ট্রাইব্যুনাল সংক্রান্ত দুর্বলতাগুলো শোধরাবার চেষ্টা করা হতো। বিদেশে লুকিয়ে থাকা অনেক কামরান সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। তবে, আমাদেরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এদের অনেকে হয়ত আপনাদের আশপাশে আছে। এদের কাউকে চিনলে বা তথ্য থাকলে দৈনিক জনকণ্ঠ বা ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কমিটিকে পাঠান। অন্তত নিজেকে বা নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে চাইলে এ কথা মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। মনে রাখবেন কামরান যা বলছে তা গোলাম আযমেরই বক্তব্যÑ বাংলাদেশ হওয়াতে তারা খুব ব্যথিত। বাংলাদেশের জন্য তাদের দুঃখ হয়। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হেফাজতে দিলেই তাদের দুঃখ দূর হবে। (সমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.