সংসদে প্রধান মন্ত্রী ॥ ‘পদ্মা সেতু হবেই ॥ ড. কামালকে ধন্যবাদ কোকোর দুর্নীতির শাস্তির তথ্য প্রকাশে আগ্রহের জন্য’

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর দেশে-বিদেশের সব দুর্নীতির তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।


একই সঙ্গে ড. কামাল হোসেনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, দেশের কিছু নেতা আছেন যাঁরা বসন্তের কোকিল। কখন যে কুহু কুহু রব ছাড়েন, আর কখন যে চুপ করে বসে থাকেন সেটাই বোঝা মুশকিল। হঠাৎ করে তিনি (ড. কামাল) এতটা উত্তেজিত ও সোচ্চার হলেন কেন, সেটাই প্রশ্ন। জার্মানি ও ফ্রান্সে কোকোর দুর্নীতির দায়ে শাস্তির তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করতে আগ্রহী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে ধন্যবাদও জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণে বিকল্প উৎস হিসেবে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনার কথা জানিয়ে বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। যে প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য, ব্যয় সাশ্রয়মূলক ও দ্রুত হবে সেটিই গ্রহণ করা হবে। যে কোনভাবেই হোক, সরকার এ সেতু অবশ্যই নির্মাণ করবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে দু’ধরনের ডিজাইন রয়েছে। দাতাগোষ্ঠী থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেলে প্রথম নকশা অনুযায়ী উপরে সড়ক ও নিচে রেল অর্থাৎ ডবল ডেকার সেতু নির্মাণ করা হবে। নিজেরা সেতুটি করতে হলে অপেক্ষাকৃত কম খরচের শুধুমাত্র পদ্মার ওপর সড়ক সেতু নির্মাণ করা হবে। ইনশাল্লাহ আমরা এ সেতু নির্মাণ করবই।
ডেপুটি স্পীকার কর্নেল (অব) শওকত আলীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারী দলের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি ও জুনাইদ আহমেদ পলকের দুটি পৃথক সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। দেশের গণমাধ্যমগুলো আরাফাত রহমান কোকোর এই দুর্নীতির তথ্য কোন্ স্বার্থে ভালভাবে প্রকাশ করেনি, সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
‘জার্মানি ও ফ্রান্সে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকোর দুর্নীতির দায়ে সাজা হওয়ার ঘটনা সরকার আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ ও প্রচার না করলে আমি নিজেই তা প্রকাশ করব’Ñ গণফোরামের এক সমাবেশে ড. কামাল হোসেনের এমন বক্তব্য সম্পর্কে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কঠোর পদক্ষেপ আর দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলেই বিরোধীদলীয় নেত্রীর পুত্র কোকোর দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো অনেক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। আর ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বড় উপদেষ্টা ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তখন কেন তিনি এই দুর্নীতির বিষয়টি ধরতে পারেননি। আমরা দুর্নীতির বিষয়টি ধরেছি এবং দুর্নীতির অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ আবারও নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নসংক্রান্ত ঋণচুক্তি বাতিল যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত হয়নি। এতে এদেশের জনগণের বহুপ্রত্যাশিত পদ্মা সেতু নির্মাণ কিছুটা হলেও পিছিয়েছে। সরকারী দলের সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা আরও বলেন. বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বিকল্প উৎস হিসেবে গত ১০ এপ্রিল পদ্মা সেতু ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এর ভিত্তিতে সে দেশের সরকার ২৭ আগস্ট কনসেশন চুক্তির খসড়া কপি সরবরাহ করেছে, যা যাচাই করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ বসে নেই। শুধু মূল সেতু নির্মাণের কাজে বিশ্বব্যাংকের কারণে কিছুটা বিলম্ব ঘটেছে। সরকারী নিজস্ব অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি অনুসন্ধান চালিয়েও কোন দুর্নীতির তথ্য পায়নি। অথচ বিশ্বব্যাংক কোন অর্থ ছাড়ই দেয়নি। অর্থ ছাড় না দিয়েই সেখানে দুর্নীতির গন্ধ পেল!
তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে মূল সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় তা প্রমাণ হয়নি। নির্মাণ তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কথিত ‘দুর্নীতির সম্ভাব্যতা’ বিষয়টি সম্পর্কে দুদক স্বাধীনভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় কেবলমাত্র মূল সেতু এবং নির্মাণ তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বোর্ড সভায় কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট পদ্মা সেতুতে অর্থায়নসংক্রান্ত ঋণচুক্তি বাতিল করেন।
তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। যে প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য, ব্যয় সাশ্রয়মূলক ও দ্রুত হবে সেটাই গ্রহণ করা হবে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণকল্পে কোন অর্থ দাতা সংস্থাসমূহ কর্তৃক ছাড়করণ হয়নি বিধায় বৈদেশিক ঋণের কোন অর্থও ব্যবহার হয়নি।
শাহরিয়ার আলমের অপর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতার আসার আগে বলা হয়েছিল দেশ নাকি গ্যাসের ওপর ভাসছে। গ্যাস বিক্রির জন্য আমাদের ওপর অনেক চাপ দেয়া হলেও আমি রাজি হয়নি। এ কারণে আমাদের অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাসকূপ থেকে গ্যাস পাওয়া গেছে। গ্যাস প্রাপ্তিসাপেক্ষে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে যেখানে প্রয়োজন সেখানে গ্যাসের সংযোগ দেয়া হবে। ওয়াদা যখন দিয়েছি অবশ্যই রাজশাহীতেও গ্যাস যাবে।
গোলাম দস্তগীর গাজীর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুত অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় ৪১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত রেখে এসেছিলাম। কিন্তু সাত বছর পর ক্ষমতা এসে পেলাম ৩২শ’ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এই সাত বছরে বিদ্যুত উৎপাদন না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে গেছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। তাই এবার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে ত্বরিতগতিতে বিদ্যুত উৎপাদনে বেশকিছু ব্যবস্থা নিতে হয়। তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনী ওয়াদা দিয়েছিলাম ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুত উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করব। আমরা নির্বাচনী ওয়াদার চেয়েও বেশি অর্থাৎ প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি।

যোগাযোগ ব্যবস্থা
একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণপূর্বক নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অগ্রাধিকারের মধ্যে প্রথমে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সকল শ্রেণীর সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। পরবর্তী অগ্রাধিকারে রয়েছে যথাক্রমে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। শেষ ধাপে রয়েছে নতুন সড়কের জন্য গৃহীত নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন।
তিনি বলেন, সড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ব্যবস্থাধীনে ২১ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক হচ্ছে তিন হাজার ৫৭০, আঞ্চলিক মহাসড়ক চার হাজার ৩২৩ এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ৬৭৮ কিলোমিটার। এ সকল সড়কের বিভিন্ন স্থানে চার হাজার ৫০৭টি ব্রিজ, ১৩ হাজার ৭৫১টি কালভার্ট ও ৬০টি ফেরি সার্ভিস রয়েছে। প্রত্যাশিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনুকূলে টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ২০ বছরমেয়াদী রোড মাস্টার প্ল্যান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সড়ক ছাড়াও রেল যোগাযোগ উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৩০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৩৫টি এবং পাঁচ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ১১টি সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন করেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ৩৬ হাজার ২১৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ১৪৯টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত আছে। অপরদিকে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৬০ কিলোমিটার নৌরুট ড্রেজিং করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কর্ণফুলী নদীতে ৩.৫০ কিলোমিটার নৌপথ ড্রেজিং করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.