সূচক আবারও চার হাজারের নিচে-বিপর্যয়ে শেয়ারবাজার, কেনার কেউ নেই by সুজয় মহাজন

অনেকের কাছেই শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা যেন ১৯৯৬ সালেরই পুনরাবৃত্তি। সে সময়ে সূচক যতটা না কমেছিল, তার চেয়ে বেশি কমেছিল পরবর্তী দুই বছরে। সে সময় কাগুজে শেয়ার নিয়ে হয়েছিল নানা কারসাজি।
এবার কাগুজে শেয়ার নেই। বাজারে ক্রেতাও আছে।


তাই এখনকার বাজারকে হয়তো পুরোপুরিভাবে ১৯৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি বলা যাবে না। তবে পতনের দিক থেকে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর ডিএসইর সূচক ওই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৬৪৫ পয়েন্টে উঠেছিল। সেখান থেকেই পতন শুরু হয়, ১৯৯৮ সালে নেমে আসে মাত্র ৪৬২ পয়েন্টে। লেনদেনও ১০০ কোটি টাকা থেকে কমে ৩০ কোটিতে নেমে আসে। সূচকের ক্রমাগত পতনের দিক থেকেই অনেকে দুই সময়ের মধ্যে মিল খুঁজে নিচ্ছেন।
বাজারসংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ অবশ্য বাজারের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৯৬ সালের চেয়েও ভয়াবহ বলে অভিহিত করেছে। কেননা, ১৯৯৬ সালের বাজারে ঋণের কোনো বিষয় ছিল না। তখনকার বাজারে বিনিয়োগকারীদের পুরোটাই ছিল তাঁদের নিজস্ব বিনিয়োগ। তাই তখন যাঁরা শেয়ার নিজের নামে হস্তান্তর করে অপেক্ষা করেছিলেন, তাঁরা দীর্ঘ সময় পর হলেও মুনাফা পেয়েছেন।
কিন্তু এবার টানা দরপতনের কারণে ইতিমধ্যে তাঁদের নিজস্ব বিনিয়োগের পুরোটাই চলে গেছে। এমনকি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণেরও পুরোটাই প্রায় যায় যায় অবস্থায় রয়েছে। এ জন্য বিনিয়োগকারীর চেয়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন ঝুঁকিতে রয়েছে।
গ্রাহক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ঋণচুক্তি অনুযায়ী, ‘গ্রাহকের নামে কেনা শেয়ারগুলো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক থাকে। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে তার প্রদত্ত ঋণ আদায়ের জন্য গ্রাহককে না জানিয়েও ওই শেয়ার বিক্রির অধিকার সংরক্ষণ করে।’ সেই হিসাবে মূলত ঋণ নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের শেয়ারের মালিকানার অধিকার প্রকারান্তরে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছে। পুঁজি তো গেছেই, তার পরও তার সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাবে যোগ হচ্ছে ঋণের সুদ।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, লেনদেন ও সূচক পতনের দিক থেকে ’৯৬ সালের সঙ্গে এবারের বাজারের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তবে ’৯৬ সালে বাজার অনেক ছোট ছিল, তাই তার প্রভাবও ছিল কম। অর্থনীতিতে সেটির খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব ছিল না। কিন্তু বর্তমান বাজার অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। এ কারণে এবারের পতন অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের পতন ’৯৬ সালের পতনের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, যেহেতু ’৯৬ সালের পর বাজারে অনেক সংস্কার হয়েছে, সেহেতু এবারের পতন কাটাতে হয়তো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ, বর্তমান বাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেশি। ’৯৬ সালের তুলনায় এটিই এই বাজারের সবচেয়ে বড় আশা ও শক্তির দিক।
এদিকে বাজারের ধারাবাহিক দরপতনে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন চরম হুমকির মুখে রয়েছে। ইতিমধ্যে কমবেশি ছাঁটাই প্রক্রিয়া চলছে ব্রোকারেজ হাউসে। লোকসান কমাতে প্রতিষ্ঠান মালিকেরাও ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড সংকুচিত করে আনছেন। বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। সেকেন্ডারি বাজারের পর এবার প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর বাজারেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিপর্যয় রোধে অনুমোদন দেওয়া একটি কোম্পানির আইপিওর চাঁদা গ্রহণ প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
গতকালের বাজার: টানা দরপতনে গতকাল মঙ্গলবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক নেমে এসেছে চার হাজার পয়েন্টের নিচে। চলতি অর্থবছরের (২০১২-১৩) শুরুটাই হয়েছিল বড় ধরনের দরপতন দিয়ে। এর ফলে মাত্র কয়েক দিনেই সাড়ে চার হাজার থেকে ডিএসইর সূচক নেমে এসেছে চার হাজারের নিচে।
অর্থবছরের সাত কার্যদিবসের মধ্যে ছয় দিনই বাজারে দরপতন ঘটেছে। এর মধ্যে তিন দিন বড় ধরনের পতন। গতকাল এক দিনেই ডিএসইর সাধারণ সূচক পৌনে ৪ শতাংশ বা ১৫৬ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে তিন হাজার ৯৮৯ পয়েন্টে। গত প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইর সাধারণ সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ সূচক প্রায় তিন হাজার ৮১০ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক গতকাল এক দিনে প্রায় সোয়া ৩ শতাংশ বা ৪১৩ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে ১২ হাজার ২১৯ পয়েন্টে। সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে এটিও সিএসইর সার্বিক সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক ১২ হাজার ১১৩ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। দুই বাজারে গতকাল লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডিএসইতে ৯১ শতাংশের এবং সিএসইতে ৯৫ শতাংশেরই দাম কমেছে।
দরপতন সত্ত্বেও দুই বাজারে গতকাল লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। ডিএসইতে দিনশেষে প্রায় ১৮৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা বেশি। আর সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩০ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় চার কোটি টাকা বেশি।
আইপিওর বাজারেও ধস: ডিএসইর হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে এ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে আটটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে তালিকাভুক্ত হওয়া চারটি কোম্পানির শেয়ারের দামই নেমে এসেছে বিক্রয়মূল্যের নিচে। এগুলো হলো: আমরা টেকনোলজিস, সায়হাম কটন, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস (ওয়েস্টিন হোটেল) ও জিবিবি পাওয়ার। গতকালের সর্বশেষ দর অনুযায়ী, আমরা টেকনোলজিসের ২৪ টাকার আইপিও শেয়ারের দাম নেমেছে ২০ টাকায়, ২০ টাকার সায়হাম কটনের শেয়ারের দাম এখন ১৬ টাকা ৭০ পয়সা, ৭৫ টাকার ইউনিক হোটেলের দাম নেমেছে ৭২ টাকা ৮০ পয়সায় আর ৪০ টাকার জিবিবি পাওয়ারের শেয়ার এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
আইপিওর শেয়ারের বর্তমান অবস্থায় নতুন অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলো আইপিওর চাঁদা গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসছে। গতকাল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সভায় সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার কোম্পানির চাঁদা গ্রহণ কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
এসইসি জানিয়েছে, কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন চাঁদা গ্রহণের সময় পরে অবহিত করা হবে। ১৫ জুলাই থেকে কোম্পানিটির আইপিওর চাঁদা গ্রহণ কার্যক্রম শুরুর কথা ছিল বলে ডিএসইর তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসইসির সভা: শেয়ারবাজার ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে এসইসি। কমিশনের গতকালের সভা শেষে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। একই সঙ্গে কমিশন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য আইপিওতে কোটা সংরক্ষণের বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সভা শেষে এসইসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আগামী ১৪ আগস্টের মধ্যে ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর ব্রোকারেজ হাউসগুলো দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে এ বিষয়ে অবহিত করবে। পরে ৩০ আগস্টের মধ্যে ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে এসইসির কাছে চূড়ান্ত তথ্য দাখিল করবে।
কেনাবেচায় যারা শীর্ষে: এসইসি ও ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গতকালের বাজারে শেয়ার কেনার দিকে থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত ক্রয়ের (নেট বাই) পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে আইসিবি সিকিউরিটিজের প্রকৃত ক্রয়ের পরিমাণ ২২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বেশি।
বিক্রেতার দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রকৃত বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ছয় কোটি টাকা। বাকি নয়টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় নয় কোটি টাকা।

No comments

Powered by Blogger.