ইউনূসকে নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন অসংযত আচরণ by সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব বাবুর বাংলাদেশ সফরের পর হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন এক মেরুকরণ হতে শুরু করেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার ডাকসাইটে মন্ত্রী মহোদয় ও নেতারা একের পর এক অত্যন্ত আশালীন ও নোংরাভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে নানা তীর্‍যক মন্তব্য, আশালীন ভাষায় আক্রমণ, নানা কটূক্তি দেখে সাধারণ জনগণের মতো বিস্মিত না হয়ে পারিনি। ভেবে অবাক হই, খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের মতো দায়িতত্বশীল এবং রুচিশীল এক নেতা কেমন করে এমন আসংলগ্ন নিম্নরুচিসম্পন্ন বস্তাপঁচা মন্তব্য করতে পারলেন? সৈয়দ আশরাফের এমন অস্বাস্থ্যকর, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের পথ অনুসরণ করে তারই যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ আরো একধাপ এগিয়ে গায়ে পড়ে ইউনূস সাহেবকে নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। সাম্যবাদী দলের দিলীপ বাবুতো উপযাজক হয়ে ড. ইউনূস ও আবেদ সাহেবকে তত্বাবধায়ক নিয়ে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামার আহবান জানিয়েছেন।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে আমাদের বিজ্ঞ, জানু আমলা, অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী ইউনূস ও গ্রামীণব্যাংক ইস্যুতে আরো কঠোর মন্তব্য করেছেন।

ভেবে অবাক হই হঠাৎ করে সরকারের পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা ইউনূস সাহেবকে নিয়ে এতো ক্ষেপে গেলেন কেন? সংবাদপত্র ঘাঁটাঘাটি করে এই সময় তো ইউনূস সাহেবের এমন কোনো সরকারবিরোধী কিংবা সরকারের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয় এমন কোনো কাজের বর্ণনা কিংবা ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সৌজন্যমূলক বৈঠকেও তো সরকারবিরোধী এমন কোনো বিষয় আলোচনা হয়েছিল বলে তো তাদের কোনো আলোচনার এজেন্ডা বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়নি। তাহলে ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপমানজনকভাবে বের করে দেয়ার পরেও এই ব্যক্তিকে নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মাথাব্যাথার কারণ কি?

এমনকি হিলারির সফরের পরেও ইউনূস সাহেবকে তো কোথায়ও এমন কোনো সরকার বিরোধী কোনো বক্তব্য বা লবিং করতে দেখা যায়নি। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যখন প্রশ্ন তুলেছে প্রকাশ্যে, তখনোতো ইউনূস সাহেবকে এ ধরনের উদ্বেগজনক কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। বিএনপি এবং তার মিত্ররা যখন ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনায় সোচ্চার, দেশের বিবেক, অভিভাবক হিসেবে ইউনূস সাহেবকেতো সেক্ষেত্রেও একেবারে চুপ থাকতে দেখা যাচ্ছে।তাহলে সরকার ইউনূসকে নিয়ে এতো ক্ষ্যাপা কেন?

সৈয়দ আশরাফ দেশে-বিদেশে একজন সজ্জন, ভদ্র রাজনীতিবিদ হিসেবে সর্বাদিক সমাদৃত।বিগত মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আব্দুল জলিলের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার,শালীন এবং পরিমিত বক্তব্য দিয়ে দল এবং দলের বাইরে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। ইংল্যান্ডের মতো গণতান্ত্রিক সভ্যতার সূতিকাগার এবং মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে থেকে এবং সেখানকার ব্রিটিশ লেবার পার্টির স্থানীয় এক নেতা এবং সদস্য হওয়ার সুবাদে সৈয়দ আশরাফ চাল-চলন, কথা-বার্তায় এক বিশেষ নান্দনিক মুন্সিয়ানা পরিলক্ষিত হতো।সবকিছু ছাড়িয়ে সৈয়দ আশরাফের সবচাইতে যে পরিচয়টি বড় করে সবার কাছে প্রতিভাত এবং গৌরবোজ্জ্বল করে তুলেছিল তা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী সরকারের অন্যতম কর্ণধার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য সন্তান হিসেবে।

কিন্তু পত্রিকার পাতায় সৈয়দ আশরাফের ইউনূসকে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনে হতবাক হয়ে যাই।মনে হচ্ছিল এ যেন আশরাফ নন, অন্য কেউ কথা বলছিলেন। কারণ আমরা যে আশরাফ ভাইকে চিনি, তিনি তো এমন আশালীন বক্তব্য দিতে পারেন না? আর যাই হোক সৈয়দ নজরুলের সন্তান এমন অরুচিকর বক্তব্য কমপক্ষে দেশের একজন স্বনামধন্য প্রতিতযশা ব্যক্তিকে নিয়ে করতে পারেন না।

হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব বাবুর সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংলাপের ওপর গুরুত্ত দেয়া হয়েছে। সৈয়দ আশরাফও সংলাপের বিরোধী নন।আর ইউনূস এবং আবেদ সাহেব নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন ওই বৈঠকে।শুধু কি সে জন্য সরকার ইউনূসের ওপর ক্ষেপেছেন?যদি তাই হতো তাহলেতো আবেদ সাহেবের ওপরও সরকারের চটার কথা,কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব বাবু সংলাপের সাথে গ্রহণযোগ্য সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে গেছেন।

আওয়ামী লীগ এবং তার সরকার প্রধানের এখানেই যত আপত্তি।ইউনূসকে নিয়ে এখানে সব তাল-গোল পাকিয়েছে।সরকার দেখেছে, তত্ত্বাবধায়ক না হলে তাদের তৈরি ফর্মূলায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সর্বজন গ্রাহ্য এবং দাতা ও বিশেষ করে আমেরিকা, ভারত, বৃটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ শিক্ষিত, মার্জিত, জাতির অভিভাবক হিসেবে নোবেল বিজয়ী এই ড. মোহাম্মদ ইউনূসই এতো কিছুর পরেও চলে আসেন এবং দাতাদের ফর্মূলায় শেষ পর্যন্ত তাই হবে-এই যখন প্রতীয়মান হতে চলেছে, সরকার তখন আগে-ভাগেই, একরকম গায়ে পড়ে ইউনূসবিরোধী স্রোত এবং বৈরী বলয় তৈরিতে উঠে-পড়ে লেগেছে বলে অবস্থা দৃশ্যে তাই মনে হচ্ছে।

সরকার নানা কসরত ও ফন্দি-ফিকির করে বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনের বাইরে রাখার যে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে দাফন করে নিজেদের অন্তর্বর্তী সরকারের যে ফর্মুলা বাস্তবায়নের নীল-নকশা করে এগিয়ে যাচ্ছিলো, ঘাটের পয়সা খরচ করে, বহু তদবির করে হিলারি ও প্রণব বাবুকে নিয়ে এসে যে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিলো, তা যখন ভেস্তে যেতে বসেছে। নিজেদের পাতা ফাঁদে সরকার যখন নিজেই পরে কোপোকাত হতে যাচ্ছে, তা দেখে কি সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি?সুতরাং ইউনূস খেদাও আন্দোলন না করলেতো আর রক্ষা নাই-আর সরকারের করিৎকর্মা হর্তা-কর্তারা তাই ইউনূসবিরোধী বাজার তৈরিতে উঠে-পড়ে লেগে গেছেন।

তাই বলে কি এতো নোংরা-অশ্লীল ভাষায় ইউনূসকে আক্রমণ করতে হবে? সিডনি প্রবাসী ফজলুল করিম যথার্থই বলেছেন, ওয়াইন, স্যান্ডউইচে যখন নোবেল পাওয়া যায়, তাহলে একটা নোবেল এনে দেন আশরাফ সাহেব?শান্তিতে নোবেল উপাধীকে আশরাফ ভাই যখন প্রশ্ন তোলেন তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না তাদের কি উদ্দেশ্য বা কি ম্যাসেজ, তাদের মতো নেতারা জাতি ও সমাজকে দিতে চান?

ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, বর্ণবাদী নেতা ডি ক্লার্ক, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক গুন্টার গ্র্যাসসহ অসংখ্য পণ্ডিত, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন, কেউ কখনো ওয়াইন আর স্যান্ডউইচ খাওয়াইয়ে নোবেল পেয়েছেন বলে তো শুনিনি।আর ইউনূস সাহেব যে নোবেল পেয়ে গোটা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে অনেক উপরে তুলেছেন, তা আপনাদের মতো রাজনৈতিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিরা না মানলেও ইউনূসের কিছুই আসে যায় না। কারণ গোটা বাংলাদেশ এবং বিশ্বসভা ও বিশ্বমানবতা জানে ইউনূসের মর্যাদা, ইউনূসের প্রতিভা। আপনি একজন আশরাফ, একজন হানিফ কিংবা একজন দিলীপ বাবুর মতো রাজনৈতিক ফেরিওয়ালারা ইউনূসকে হেয় করতে পারেন, কিন্তু বিশ্ব ইউনূসকে যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করছে, তা থেকে নামাবেন কি করে?আপনাদের আশালীন বক্তব্য শুনে বানরের ওই তেল মেখে গাছে উঠার গল্পের কথাই বারে বার মনে পড়ে, যে বারে বার উপরে যতটুকু উঠে, ততোবার ঠিক ততটুকু নিচে নেমে আসে।

কিছুদিন আগে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক বদরুদ্দীন উমরের এক লেখায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক শিষ্টাচার একেবারে নিচে নেমে গেছে।আসলেই তাই, কারণ সরকারের নেতা-নেত্রীদের কথাবার্তা এতো অসংলগ্ন ও অশালীন যে রীতিমতো তা নষ্টবাজারের খিস্তি-খেউড়ির পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দলে যখন অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ধ্যান-ধারণার লালন ও চর্চা করা হয়, দলটিকে যখন একে বারে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পচন ধরে ক্ষয়ে যায়, তখন জাতি হিসেবে আমরা শংকিত হই।আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় তখন হুমকির মুখে।আর এই আশঙ্কার কথা আরো সুন্দরভাবে মাত্র কিছুদিন আগে সেক্টর কমান্ডার ফোরামের আরো এক তাত্ত্বিক নেতা শাহরিয়ার কবির কষ্টের সঙ্গে বলেছেন, “এই সরকারের যখন পতন হবে তখন এদের কাউকেই দেশে পাওয়া যাবে না, হারিস চৌধুরীর মতো এরা সবাই দেশ থেকে পালাবে, কিন্তু আমি শাহরিয়ার কবির যাবো কোথায়?”

সরকারের পায়ের তলায় যে মাটি সরতে শুরু করেছে, তা যে কেউই সহজে অনুমান করতে পারছেন। যে কারণে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের জনপ্রিয়তায় ভাটা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো আবোল-তাবোল বলা শুরু করে দিয়েছেন।

সম্মান পেতে হলে অপরকেও সম্মান দিতে হয়, আপনি নিজে যদি কাউকে সম্মান না দেন, তাহলে অপরের কাছ থেকে কী করে সম্মান আশা করেন? মনে রাখবেন, একদিন এই অসম্মানিত আচরণই আপনার জন্য অপমানের কারণ হয়ে দেখা দেবে। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায়, যা ইচ্ছা খুশি কিছুদিন করা যায়, ক্ষমতার দাপটে যখন-তখন যা খুশি বলা যায়, করা যায়, কিন্তু তা কখনো স্থায়িত্ব পায় না, মানুষের মনের শ্রদ্ধার আসনে বসা যায় না। আর যে জাতি তার গুণীজনদের সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির কপাল থেকে দুর্ভোগের কালিমা কখনো সরে না। যুগে যুগে মানব সভ্যতার ইতিহাস তাই বলে।

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ: বৃটেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা
                                 ইমেইল: salim932@googlemail.com

No comments

Powered by Blogger.