মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতিবহ “নিমকহারাম দেউরি”

২৩ শে জুন, ১৭৫৭ সালের এই দিনেই সংঘটিত হয়েছিলো ঐতিহাসিক পলাশির যুদ্ধ। এই দিন থেকেই পরবর্তী প্রায় দু’শ বছরের জন্য সুবা বাংলার স্বাধীনতা বাধা পড়ে ব্রিটিশ গোলামির জিঞ্জিরে। বাংলা, বিহার, উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্যোউলা এই দিনই পলাশির আম্রকাননে প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত হন ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর কাছে।

এই পলাশি যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি দরোজা যার নাম ‘নিমকহারাম দেউরি’ বা বেইমানের দরোজা। বিশ্বাসঘাতককূল শিরোমণি মীর জাফর আলি খানের প্রাসাদের প্রধান ফটককে জনসাধারণ পরবর্তীতে এই নামেই অভিহিত করা শুরু করে।
নবাব সিরাজের পক্ষে পলাশির ময়দানে প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীর জাফর আলী খান। ভারতীয় উপমহাদেশবাসীর কাছে যার নাম বেইমানি আর বিশ্বাসভঙ্গের সমার্থক হিসেবে ঘৃণিত।

ইংরেজদের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে এদিন তিনি তার বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকেন। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন মোহনলাল আর মীর মর্দান, নবাবের ফরাসি সেনাধ্যক্ষ সাঁফ্রে’র নেতৃত্বে মুষ্টিমেয় দেশীয় সেনার ইংরেজ বিরোধী মরণপণ লড়াইকে। বাংলার স্বাধীনতা বাধা পড়বে ব্রিটিশদের জুতোর নিচে তা মূলত নির্ধারিত হয়েছিলো মীর জাফরের ভূমিকার কারণেই।

পলাশির প্রান্তরের অদূরেই ছিলো জাফরগঞ্জ প্রাসাদ। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান সপরিবারে এখানেই বসবাস করতেন। জাফরগঞ্জ প্রাসাদের প্রধান ফটকই পরে অভিহিত হয় নিমক হারাম দেউরি নামে। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে মানুষের মুখে মুখেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ঘৃণাভরা এই নাম।

বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ শহরের লালবাগ এলাকার জাফরগঞ্জ সিমেট্রির বিপরীত দিকে অবস্থিত ছিলো এই প্রাসাদটি। বুরুজ ও মিনার সম্বলিত প্রাসাদটি তখন কামান দ্বারা সুরক্ষিত ছিলো। তবে বর্তমানে প্রাসাদর  কোনো চিহ্ন না থাকলেও সেই বিখ্যাত দেউরিটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে মীর জাফরের নিমক হারামির স্বাক্ষ্য হিসেবে।

পলাশি যুদ্ধের আগের দিনের সেই কুখ্যাত বৈঠকটি এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলো ইংরেজ সেনাপতি ওয়াট, মীর জাফর এবং তার কুচক্রী পুত্র মীর মিরন।

উইলিয়াম ওয়াট ছিলেন কাশিমবাজার কুঠির প্রধান। এই কাশিমবাজার কুঠি থেকেই অঙ্কুরিত ব্রিটিশ শাসনের বিষাক্ত বিজই কালক্রমে সারা ভারতকে তমসাচ্ছন্ন করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামের বিষবৃক্ষে।

বাংলাতে বসবাসের সময় একই সঙ্গে বাংলা, হিন্দুস্থানি এবং ফারসি ভাষায় দক্ষতা লাভ করেন জেনারেল ওয়াট। পলাশী যুদ্ধের আগের দিন ওয়াটকে প্রাসাদে স্বাগত জানান জাফর পুত্র মিরন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় প্রাসাদের হারেমে। ধুরন্ধর ওয়াট মীর জাফরের মাথায় পবিত্র কোরআন এবং মীর জাফরের হাতকে পুত্র মিরনের মাথায় স্থাপন করান। মীরজাফর উপরওয়ালার নামে শপথ করেন তিনি যুদ্ধে ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন।

পরের দিনই অনুষ্ঠিত হয় পলাশীর যুদ্ধ এবং সত্যি সত্যিই বেইমানি করে যুদ্ধের ময়দানে নিষ্ক্রিয় থাকেন মীর জাফর ও ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়া মিত্ররা। বাংলার মসনদ থেকে উৎখাত হলেন নবাব সিরাজ আর ইংরেজরাও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী  মীর জাফরকে সেই পদে বসায়।

শের মুতাকরিনের বর্ণনা অনযায়ী, মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদি বেগ হত্যা করেন নবাব সিরাজকে। ১৭৫৭ সালের জুলাই মাসের দুই তারিখে মুর্শিদাবাদের অদূরে রাজপথের ধারে একটি নিম গাছের নিচে প্রাণ হারান বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। জীবন বাঁচাতে ওই পথ ধরে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন তিনি।

তবে রবার্ট ওর্মের বর্ণনামতে, ভাগিরথী নদীর তীরের মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে হত্যা করা হয় সিরাজকে। এই প্রাসাদের অপর পাশেই অবস্থিত নিমকহারাম দেউরি বা জাফরগঞ্জ প্রাসাদ। জনশ্রুতি আছে মির মিরান তার বিলাসকুঞ্জ হিসেবে ব্যবহার করতেন মনসুরগঞ্জ প্রাসাদকে।

হত্যার পর নবাব সিরাজের মৃতদেহ সারারাত ধরে ফেলে রাখা হয় জাফরগঞ্জ প্রাসাদে। পরেরদিন তার হাতির পেছনে বেঁধে সারা মুর্শিদাবাদ নগরে ঘোরানো হয় তার মৃতদেহ। 

নিমকহারাম একটি হিন্দি শব্দ যার মানে এমন কেউ যাকে বিশ্বাস করা যায় না (যার নুন খায় তার ক্ষতি করে)। আর দেউরি বলতে বোঝায় দরোজা। তাই নেমক হারাম কথাটার অর্থ দাঁড়ায় অবিশ্বাসীর দরোজা বা বেইমানের দরোজা।

বেইমান মীর জাফরের কুকীর্তির স্বাক্ষ্য হিসেবে সেই নেমকহারাম দরোজা এখনও দাঁড়িয়ে আছে ভাগিরথীর তীরে। মীর জাফরের দূষিত মৃতদেহ পঁচে গলে মিশে গেছে মাটিতে, নওয়াবি আমলের প্রায় সব স্থাপনাই আজ ধূলিসাৎ, তবে সেই নেমকহারাম দেউরি আজও দাঁড়িয়ে আছে মীর জাফরের বেইমানির প্রীক হয়ে।

No comments

Powered by Blogger.