পারে সবচেয়ে বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠান by সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সমাজের নানাকিছু তুলে ধরতে গণমাধ্যম ওয়াচডগ বা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকরা তো আছেনই, এর সাথে সাধারণ নাগরিক, নানা ধরনের সুশীল সংগঠনও আজ গণমাধ্যমের ভুমিকা পরখ করে দেখছে যে কোন ইস্যুতে তারা কী ধরনের ভুমিকা রাখছে। আর সব ক্ষেত্রেই তাদের পর্যবেক্ষণের দিকটা হলো-

গণমাধ্যম তার মৌল নীতিমালা মেনে চলছে কিনা। সাংবাদিকদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা - সত্য তুলে ধরবেন তারা। তারা সংবাদের প্রতি, মানুষের প্রতি ন্যায্য আচরণ করবেন, সংবাদে ভারসাম্য বজায় রাখবেন। আর এসবই হলো তার জন্য বড় নীতিমালা।

উন্নত বিশ্বে গণমাধ্যম এখন এমন সব দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের মুখোমুখি হচ্ছে যারা প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের কোনো রিপোর্ট, সম্পাদকীয় বা বিজ্ঞাপন ভালো না লাগলে, কেন ভালো লাগছে না তার কারণসহ বিভিন্ন ধরনের কমিশন বা সংস্থার কাছে অভিযোগ করছে।  আবার এসব কমিশন গঠন করছে স্বয়ং গণমাধ্যম মালিক ও সাংবাদিকরাই।

গণতান্ত্রিক সমাজে মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ চায় সাহসী সাংবাদিকতা। কিন্তু এর জন্য শুধু সাংবাদিকদের চেষ্টাই বড় নয়, চাই সমাজের সব মানুষের, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সরকারি প্রশাসন ও সুশীল সমাজের সহযোগিতা।

আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে সাধারণ মানুষ আর গণমাধ্যম কর্মী সবারই প্রচেষ্টা-‘ভালো সাংবাদিকতা’। আর তাই সাংবাদিকদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই যে যা হচ্ছে তাই যথেষ্ট। কারণ সমাজের একটি বড় অংশ এখনো মনে করে সাংবাদিকরা মূলত অহংকারী, অসংবেদনশীল এবং পক্ষপাতদুষ্ট। তারা অসত্য বলে বা লিখে এবং চাঞ্চল্যসৃষ্টিতে পারদর্শী।

তবে এই নেতিবাচক মনোভাবের পরও মানুষ সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে চায়।

তা হলে কি করা যায়? ঘুরে ফিরে ভূমিকার কথাটাই আসে। মানুষও অনেক প্রত্যাশা করে। তবে আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাংবাদিকরা শুধু কোনো ঘটনা বা বিষয় কভার করে না, তারা নানা ইস্যুতে বিতর্কও সৃষ্টি করছেন। পশ্চিমা বিশ্বে সেলিব্রিটি বা পাবলিক ফিগারদের নিয়ে এটা বেশি হলেও আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে তা হয় রাজনৈতিক ইস্যুতে। 

তাই প্রশ্ন উঠছে-এমন কোনো সাংবাদিকতা কি আসবে যা মানুষকে শুধুই জানাবে না, বরং তাদের অংশীদার করে ফেলবে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সাথে?

তা হবে কিনা জানা নেই। তবে একথা তো সত্য যে সাংবাদিকতা এখন আর খুব সাধারণ জায়গায় নেই। সাংবাদিকরা চায় এর সংজ্ঞা প্রসারিত হোক। তারা কোনো ঘটনা, কোনো সভা, কোনো বিতর্ক কভার করার পাশাপাশি, এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কিভাবে ঐক্যমত সৃষ্টি করতে পারে তাও ভাবতে চায়। শুধু সাফল্য বা ব্যর্থতার কথা নয়, চায় মানুষ কিভাবে তার কঠিন সময়কে অতিক্রম করছে তা জানতে, জানাতে।

আর তা করতে গেলে দরকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। গণতন্ত্র আসলে অনেক বেশি করে চায় অনুসন্ধানী রিপোটিং। সেই বহুল আলোচিত চতুর্থ স্তম্ভ মডেলেই বলা হয়েছে জনস্বার্থ আছে এমন সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যম সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করবে। সরকারের সাফল্য- ব্যর্থতা তুলে ধরবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা তুলে ধরাই সাংবাদিকতার নীতি। এভাবেই গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে সংহত করতে দায়িত্ব পালন করে।

কিন্তু বিষয়টা সহজ নয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে ’রাজনৈতিক অভিজাত’রা কিন্তু বিষয়টি সেভাবে দেখেন না। তারা মুখে বলেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা, কিন্তু বাস্তবে তারা চান গণমাধ্যম শুধু তাদের সাফল্যগাথা তুলে ধরুক। যে সংবাদে মানুষ বিরুপ হয়, সমাজে অসন্তোষ দেখা হয়, সমালোচনা হয় ক্ষমতায় থাকা কর্তাব্যক্তিরা, তা তারা পছন্দ করেন না। 

তথ্যই হলো মানুষের ক্ষমতায়নের সবচেয়ে বড় হাতিযার। তথ্য মানুষকে সজাগ রাখে, সরকারকে, এমনকি বিরোধী দলকে দায়বদ্ধ করে।  আর তাই যদি সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরতে পারে ঠিকভাবে, দলবাজি সাংবাদিকতা পরিহার করে সংবাদের প্রতি, মানুষের প্রতি ন্যায্য আচরণ করতে পারে, সংবাদে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে, তবে আগামীর বাংলাদেশে গণমাধ্যমই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:  বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন

No comments

Powered by Blogger.