শেয়ারবাজার : যেসব দিকে দৃষ্টি দিতে হবে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

চরম মন্দাভাব থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন করে এক লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারের চৌহদ্দির ভেতর এলেন, এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত কিছু শঙ্কা এবং সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে আলোচনা করার আগে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।


শেয়ারবাজারের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আনার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন_রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বেশি করে শেয়ার কিনতে। আইসিবি তো রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি না করতে। অবাধ মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক হলে এসব নির্দেশের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। মার্চেন্ট ব্যাংক পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নিয়মকানুন অনুযায়ী। মার্জিন ঋণের মার্জিন কমে গেলে পোর্টফলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় সাধন করার কথা।
এবার আসি ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রসঙ্গে। জনগণের গচ্ছিত অর্থ থাকে ব্যাংকে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনার জন্য নির্দেশাবলি দিয়ে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার জন্য যেন অবদান রাখতে পারে। সব শ্রেণীর বিনিয়োগ তথা স্বার্থ যেন সংরক্ষিত থাকে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিয়োগযোগ্য অর্থের কত ভাগ শেয়ারে বিনিয়োগ করবে, তাও বলা আছে। অতএব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ব্যাপকহারে শেয়ারে বিনিয়োগ করার আদেশ আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য কি না সে প্রশ্ন করা যায় বৈকি। বলা হচ্ছে, ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছেন। যৌথ বিও অ্যাকাউন্ট খোলার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া এই বিও অ্যাকাউন্ট খোলা নিয়ে নানা দুর্নীতি এবং অনিয়মের কথাও শোনা যায়। সেসব প্রশ্ন না তুলে শুধু যৌথ অ্যাকাউন্টকে হিসাবে নিলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২৫ লাখের মতো হবে। তাহলে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের কম মানুষ শেয়ারবাজারে জড়িত।
বর্তমান সরকারের প্রথম দিককার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে শেয়ারবাজারের এই বিপর্যয়ের দায়ভার বিরোধী দল সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। ফলে এখন আর বিধিনিষেধ দেখার সময় নেই। আপৎকালীন পরিস্থিতি মনে করে সেভাবে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিছু সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। শেয়ারের মূল্য কখনো বাড়ছে আবার কমছে। যেকোনো বাজারে দ্রব্যমূল্য ওঠানামা করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘদিন একটানা শেয়ারের মূল্য অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় কিছুসংখ্যক বিনিয়োগকারী নামার ব্যাপারটা একেবারে মেনে নিতে পারছেন না। সবার উচিত আরো কিছুদিন এ অবস্থার পর্যবেক্ষণ করা। অর্থমন্ত্রী নতুন এক লাখ বিনিয়োগকারী সম্পর্কে যা বলেছেন, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে এমন দুর্দিনেও যাঁরা আসছেন, তাঁদের ভেতর কারো কারো কি ফটকাবাজি করার মতলব আছে? শেয়ারে বিনিয়োগ করতে এলে প্রথমেই একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। শুধু মার্চেন্ট ব্যাংক এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যের প্রতিষ্ঠানে খোলা যায়।
শেয়ারবাজারের বাইরে কোনো লেনদেন আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৯৬ সালে কার্ব মার্কেট সক্রিয় ছিল। এখন শেয়ারের লেনদেন দুইভাবে বৈধতা পায়। প্রথমত, সরাসরি স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ডিবিবিলে তথ্য পাঠানো হয়। আর যে কম্পানি ডিবিবিলের সদস্য নয়, সে ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন হয়েছে তার নথি সংশ্লিষ্ট কম্পানিতে যেতে হবে। অতএব কোনো অস্বচ্ছ লেনদেন বা ম্যানিপুলেশন বা ফটকাবাজি, যা-ই করা হোক না কেন, তার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক বা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য এদের ভেতর থেকে কারো সাহায্য-সহযোগিতা লাগবে। এটা সবারই জানা, পৃথিবীর সব স্টক এক্সচেঞ্জে কমবেশি নানা ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়ে থাকে। যেমন Inrider trading। কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে মান নেই। সম্ভবত টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ। এক এমডির গাড়িচালক আড়াল থেকে শুনেছিল যে ওই কম্পানি ভালো লভ্যাংশ এবং বোনাস শেয়ার দেবে। ব্যস, সে পরদিন ওই কম্পানির শেয়ার কিনতে লাগল। এতে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলো এবং ওই চালককে গ্রেপ্তারের পর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। Inrider trading-কে বলা হয় Victimers crime. কেননা নির্দিষ্ট কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি থাকে না। এ রকম ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানা ধরনের শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যা ঘটেছে, তা হলো দিনদুপুরে রাহাজানি বা ডাকাতি। কম্পানির উৎপাদন বন্ধ, তার পরও সেই কম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে চলেছে। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তার বিনিয়োগকারী এই কম্পানির শেয়ার কখনো কিনবেন না। তিনিই কিনবেন যিনি হয় ওই কম্পানি দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছেন কিংবা অন্য কোনো রকম প্রলোভনমূলক তথ্য পেয়েছেন। আর সেটি ট্রেডিং ফ্লোরের ভেতর থেকে এসেছে। কিভাবে, সেটাই তো অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন।
কোনো চক্রান্ত না থাকলে এ রকম ঘটতে পারে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম সবার মুখে ফিরেছে যে এরা বিভিন্ন রকমের অপকর্ম করছে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং একটি মার্চেন্ট ব্যাংক সম্পর্কে বলা হতো যে এরা এত শেয়ার ধারণ করে বসে আছে যে যেকোনো মুহূর্তে ইচ্ছে করলে মার্কেটকে কাবু করে ফেলতে পারে। এসব কথা এসইসি এবং ডিএসইর কানে পেঁৗছার কথা। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন উদাসীন ছিল তাও বোঝা মুশকিল। অব্যাহত দর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে কিছু নিরীহ বিনিয়োগকারীকে খোঁয়াড়ে ঢোকানো হয়েছে। তারপর তাদের সর্বনাশ করা হয়েছে। এবারও The Economist পত্রিকার ওয়েবসাইটে ১৯৯৬ সালের শিরোনামের পুনরুল্লেখ করে বলা হয়েছে, Slaughter of the Innocent. সম্মানিত পাঠক, হয়তো বলবেন যে কিছু বক্তব্য আমাদের লেখায় বারবার আসছে। কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথা বারবার বলতে হয়। অর্থমন্ত্রী নতুন বিনিয়োগকারীর আগমনকে কেন্দ্র করে যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এবারে শেয়ারবাজারে যা ঘটল তা ডিএসই এবং এসইসির ব্যর্থতার ফসল। এসইসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এসইসিকে বোঝাতে হবে যে শুধু স্টক এক্সচেঞ্জের স্বার্থ রক্ষাই তাদের কাজ নয়, তাদের কর্মপরিধি ব্যাপক।
কিন্তু ডিএসইর বর্তমান যে কাঠামো তাতে কোনো আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ এসবে কিছু হবে না। সংকট দেখলে ভালো ভালো কথা বলে। তারপর আবার যে মাথা, সেই মাথা। এত বিদেশি এঙ্পার্টের অভিমত, এত সংস্কারের পরও করপোরেট ব্যবস্থাপনা চালু করা যায়নি। এত ঝড়-তুফান উঠলেও সিইওকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কথাও উঠেছে যে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন করা হবে। তা করলে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এর জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে আশান্বিত হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। যে কমিটি করা হয়েছে তাদের কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া আইসিবি প্রধানকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। আইসিবির সঙ্গে ডিএসইর দীর্ঘদিনের আত্মার বন্ধন রয়েছে। অতএব ডিএসইর রাজত্বে কতটা আঘাত হানবে, তা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে বোধ হয় ভুল হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ শতভাগ বেসরকারি সত্ত্বেও যখন সরকারকে দায়ভার বহন করতে হচ্ছে, তাহলে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করতে বাধা কোথায়? আইসিবি, বিডিবি, সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন এসব প্রতিষ্ঠান হবে মেজরিটি বা উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। প্রতিষ্ঠানটি চলবে সম্পূর্ণরূপে মড়ড়ফ পড়ৎঢ়ড়ৎধঃব মড়াবৎহধহপব-এর ৎঁষব অনুযায়ী। কোনো কেলেঙ্কারি হলে সিইওকে আসামির কাঠগড়ায় উঠতেই হবে। এই পরিবর্তনের ফলে শেয়ারবাজারে একেবারে কোনো কেলেঙ্কারি হবে না, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। তবে পর পর দুবার যে শেয়ার গণহত্যা হলো, তা হবে না। আর অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে না।

লেখক : সাবেক ইপিএস ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.