জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-নতুন উপাচার্যের কাছে প্রত্যাশা

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষকদের বৈঠকের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাবলির জট খুলে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে শিক্ষকরা, পরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছিলেন। গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে সবাই অপেক্ষা করছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।


অবশেষে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগপত্র দিলে উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক কবিরের মেয়াদের অবসান ঘটল। জাহাঙ্গীরনগরে নেমে এলো উচ্ছল আনন্দের বন্যা। আন্দোলনরত শিক্ষকরা সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। বস্তুত অজনপ্রিয় উপাচার্য হিসেবে আখ্যায়িত শরীফ এনামুল কবির যথেষ্ট বদনাম কামিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার পর তার দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার উপাচার্য হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া। কিন্তু তা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এমনকি দলীয় উপাচার্য হিসেবেও সফলতা দেখাতে পারেননি। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মীর মধ্যেও তিনি গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি। তার মদদে জন্ম নিয়েছিল উপাচার্যপন্থি ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের এই অংশটির সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ গ্রুপের হাতেই নিহত হয়েছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়ের। মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের পর উপাচার্যের কাছে দাবি জানানো হয়, যাতে দায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি পায়। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বরাবরই তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করে অভিযুক্তদের মদদ দিয়ে এসেছেন। আন্দোলনকারীদের নানাভাবে হয়রানি ও হেয় করেছেন। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হেনস্তা করেছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে। এ ছাড়া বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্মও দিয়েছে তার প্রশাসন। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণনিয়োগ দিয়েছেন। যোগ্যতা বিচার না করে, যেনতেন প্রকারে অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষকরা দাবি তুলেছেন, গণনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই এগুলো রিভিউ করা হোক। অযোগ্যদের নিয়োগ বাতিল করা হোক। শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। গাছ কেটে, মাছ চাষের জন্য লেক লিজ দিয়ে, বিষাক্ত কীটনাশক ছিটিয়ে তিনি পাখিদের অভয়ারণ্যটিকে ধ্বংস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিস্থিতি বলছে, নতুন উপাচার্যের সামনে থাকবে অনেক চ্যালেঞ্জ। উপাচার্য হিসেবে অফিসে বসেই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে নিশ্চিত করতে হবে, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব পক্ষের মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত হয়। তাকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবিগুলো শুনতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিসম্পদ রক্ষার জন্য তিনি যদি একটি পরিবেশনীতি তৈরি করে দেন, তবে সেটি প্রশংসিত হবে। সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের ফোরামগুলোতে নির্বাচন প্রক্রিয়াও শুরু করা দরকার। জাহাঙ্গীরনগর কমিউনিটির সদস্য না হলেও দ্রুত তিনি সেই কমিউনিটির অংশ হয়েও উঠবেন_সেটি স্বাভাবিক প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সন্ত্রাস ও দলীয়করণমুক্ত সুন্দর বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার সক্রিয়তা প্রত্যাশিত। আমরা তার সাফল্য কামনা করি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাবলি আন্তরিক দৃষ্টিতে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয়। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের পদক্ষেপগুলো গণতন্ত্রসম্মত হওয়া উচিত। '৭৩-এর অধ্যাদেশ সমুন্নত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়া দরকার। সিনেট ও সিন্ডিকেটেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিশ্চিত করা উচিত। ছাত্র সংসদগুলোতেও নির্বাচন দরকার। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কোনো যুক্তিতেই অগণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার স্বার্থেই এ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
 

No comments

Powered by Blogger.