সদরে অন্দরে-সাংবাদিকের স্বাধীনতা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে by মোস্তফা হোসেইন
শহরের রাস্তা মেরামত হয় না। প্রশাসনের চোখ বন্ধ। মানুষ তাই প্রতিবাদ করল অভূতপূর্ব কায়দায়। রাস্তার মাঝখানে লাগিয়ে দিল ধানগাছ। সেই সংবাদই ছবিসহ ছাপতে দিয়েছিলেন ফরিদপুরের গৌতম দাস। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর সেই গৌতম দাসই পত্রিকার পাতায় ছবি হয়ে গেলেন। নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো গৌতমকে।
গৌতম হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি তাঁর বাবা। শাস্তি হয়েছে কি কারো? জবাবটা যে কোথা থেকে আসবে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। বরং প্রশ্ন আরো করা যায়, হুমায়ুন কবীর বালু খুন হলেন ২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনায়, একই বছর ১৫ জানুয়ারি খুলনায় খুন হন মানিক সাহা, ২০০০ সালের ১৬ জুলাই শামছুর রহমান নিহত হলেন যশোরে, ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরে নিহত হলেন সাইফুল আলম মুকুল। তাঁদের মতো আরো কিছু সাংবাদিক জীবন হারালেন এই দেশে। তাঁদের খুনের বিচার কি হয়েছে এ পর্যন্ত? খুলনার হুমায়ুন কবীর বালু হত্যা মামলার সব আসামিকে খালাস হয়ে যেতে আমরা দেখলাম। অতিসম্প্রতি ১১ ফেব্রুয়ারি, নিজ বাসভবনে নিহত হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। সাগর সরওয়ার কাজ করতেন টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙায় নিউজ এডিটর হিসেবে আর মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলায় সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে।
গৌতম দাস, মানিক সাহা কিংবা হুমায়ুন কবীর বালু খুন হওয়ার পর যেমন আমরা শুনেছিলাম দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে, এবারও আমাদের শুনতে হলো একই রকম কথা। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম একটু বেশি মাত্রায়। কারণ স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে। এমন তথ্য মিডিয়াসংশ্লিষ্টদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওষুধের মতো কাজ করল। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেল সবাইকে। ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার মুহূর্তে সাংবাদিকরা পুলিশ দপ্তরে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা এমনি করে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর একসময় আমাদের মনে করতে হলো, মানিক সাহার মৃত্যুর পর, বালু ভাইয়ের মৃত্যুর পর কিংবা গৌতম দাসের ঘটনার পর যেমন আমরা শুনেছিলাম, কিংবা তাঁদের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে যা হয়েছিল, তেমনি বোধ হয় এগিয়ে যাচ্ছে ঘটনাপ্রবাহ।
সাংবাদিকদের এভাবে মৃত্যুবরণ করা কি নিয়তি? হুমায়ুন কবীর বালুর মৃত্যুর জন্য সন্দেহ করা হয়েছিল আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে সাংবাদিকদের মৃত্যু নিয়ে যখন কথা ওঠে তখনই এ ধরনের সন্দেহ বেশি হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে বালু ভাই কিংবা শামছুর রহমানের মৃত্যুর দৃশ্যের কিনারা হয় না কিংবা আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, সংগত কারণেই আমাদের তখন প্রশ্ন করতে হয়, তাহলে এই খুনগুলো কারা করছে? সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনি স্বাধীনতা আছে। সংবিধানও সেই সুযোগ আমাদের দিয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ যদি সাংবাদিকরা কাজে লাগাতে না পারেন, যদি তাঁদের ওপর খৰ নেমে আসে, তাহলে প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে কোথায়! আমাদের সাংবিধানিক অধিকার কি বাস্তবায়ন হবে? গত ১৬ বছরের ইতিহাস আমাদের আতঙ্কিত করে দেয়। আমরা দেখতে পাই, এ দেশের লেখক এবং সাংবাদিক মিলিয়ে ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এই সময়ে। তাঁদের মৃত্যুর কারণগুলো বিশ্লেষণ করেছেন অনেকে। কিন্তু বিচার করার জন্য যেটুকু তদন্ত প্রয়োজন, হত্যা বন্ধ করার জন্য যেটুকু শাস্তি পাওয়া প্রয়োজন, সেটা কিন্তু আমাদের এখানে হচ্ছে না। দেখা গেছে, এখানে সাংবাদিক মৃত্যুর ধরনগুলো কমবেশি প্রায় একই। একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, দীর্ঘ খুনের তালিকায় থাকা সাংবাদিকদের দুই-তৃতীয়াংশই অপরাধবিষয়ক সংবাদ নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে আবার সবাই দুর্নীতি নিয়েই কাজ করতেন। তাঁদের কাজের ধরন দেখে মনে করা যায়, দুটি দুর্ধর্ষ গ্রুপেরই তাদের শত্রু হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। সাংবাদিকের বন্ধু থাকে না বলে যে কথা আছে, সেই কথা কিন্তু মৃত্যুকে ইঙ্গিত করে না। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাংবাদিকের শত্রু যেমন থাকতে পারে, তেমনি তার পেশায় সহযোগিতা করার জন্য রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের আইন নিশ্চিতভাবে তার বন্ধু হতে পারে, যদি তা যথাযথ প্রয়োগ হয়।
যশোরের শামছুর রহমান কাজ করতেন সীমান্ত এলাকার দুর্ধর্ষ চোরাচালান বিষয়ে। তাঁকে নিজ অফিসে কর্মরত অবস্থায় খুন করা হলো। বিবিসির খণ্ডকালীন সংবাদদাতা এবং দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি শামছুর রহমান এভাবে নিজ কর্মস্থলে খুন হবেন, এটা অকল্পনীয়। কোনো খুনিই শাস্তি পায়নি খুনের কারণে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। সেই স্বাধীনতা হয়তো এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আছে। কিন্তু তাঁদের সেই স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, তা কিন্তু আমাদের এখানে এখনো অনুপস্থিত। যে কারণে প্রায়ই আমাদের এমন সংবাদ পড়তে হয় এবং নৃশংসতার চিত্রও আমাদের দেখতে হয়।
দেশের সাংবাদিকদের গণ্য করা হয় শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(খ) ধারায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। কিন্তু পারিপাশ্বর্িক অবস্থা সাংবাদিকদের সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে দেয় না। বলা হয়ে থাকে, সরকার সংবাদমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে না। কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে এখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা। শামছুর রহমানের মৃত্যুর জন্য যেমন চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণকে উল্লেখ করা হয়; হুমায়ুন কবীর বালুর অবস্থান সম্পর্কে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলা হয়; তেমন হাজারো প্রতিবন্ধকতা কিন্তু এ দেশে রয়েই গেছে। তারা স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মাথাসমান দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্ব সরকারের। সামাজিক নিরাপত্তা এবং মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি বলে যে আমরা কারো মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করি না, তা হলেও তাদের দায় থেকে যায়। কারণ পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে, যাতে করে সাংবাদিক তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগেন। সবচেয়ে বড় কথা, আইনের শাসনের সঙ্গেও এর যোগসূত্র রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে কাজটিও সরকারের ওপরই বর্তায়। সেদিকেও নজর দিতে হবে। mhussain_71@yahoo.com
No comments