গতকাল সমকাল-অশান্ত মালদ্বীপে ক্ষমতার পালাবদল by ফারুক চৌধুরী

মালদ্বীপের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে আজ থেকে সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। উদ্যোক্তা-দেশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে সার্ক গঠন করার প্রচেষ্টাই ছিল আমার ওই সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য। ওই সময়ে মালেতে বিমানে অবতরণের সময় দেখেছিলাম সাগরের ফিকে নীল,


গাঢ় নীল, সবুজ, ঘোলাটে সব রং মিলে গিয়ে বর্ণহীন জল, সাগরের বুকে বর্ণময়। মনে হয়েছিল ভারত মহাসাগরের বুকে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলো যেন ছোট-বড় রঙিন পাথরের তৈরি সাগরের কণ্ঠহার। এরপর বহুবারই মালদ্বীপে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কখনো সরকারি কাজে, কখনো পর্যটকের স্বাধীনতায়, কখনো বা নির্বাচন-পর্যবেক্ষক অথবা সমাজকর্মীর দায়িত্বে। সর্বশেষ গিয়েছি ২০০৫ সালে, সুনামি-উত্তর মালদ্বীপের বিষণ্ন বালুকাবেলায়।
ইসলাম মালদ্বীপে এসেছিল দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। ১৩৪৪ সালে মরক্কোর বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর এক বছরের মালদ্বীপ অবস্থানকালে সে দেশে ইসলামি আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। তাঁকে অবশেষে শরিয়ত মোতাবেক তাঁর সেখানকার চার বিবিকেই তালাক দিয়ে ভারতের মালাবারের উদ্দেশে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। মাঝপথে তিনি মালদ্বীপের দক্ষিণের একটি দ্বীপে আড়াই মাস অবস্থান করেন এবং সেই স্বল্প সময়ের পরিধিতেই আরও দুজন মালদ্বীপবাসিনীর হূদয় জয় করতে সমর্থ হন। সে দেশে তাঁর একটি পুত্রসন্তানও নাকি জন্ম নিয়েছিল। মালদ্বীপ থেকে মালাবার হয়ে এই বিশ্ব পর্যটক ভারতের ভূখণ্ড অতিক্রম করে বাংলাদেশের সিলেটেও এসেছিলেন। কথিত আছে যে সেই সময় হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ইবনে বতুতা লিখে গেছেন, সেই সময়ে বাঙালিরা তাঁদের দেশ থেকে চাল রপ্তানি করে তার বদলে সাগরের কড়ি কিনত আর সেই কড়ি ব্যবহূত হতো তাদের নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী কেনাকাটায়। এ তো গেল ইতিহাসের ‘ধূসর’ যুগের কথা। বর্তমানে মালদ্বীপের প্রধান অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে পর্যটন। অবশ্য মালদ্বীপ তখনকার মতো এখনো মাছ রপ্তানি করে আর বাংলাদেশ করে চালের পরিবর্তে জনশক্তি।
১৯৮৫ সালে আমার প্রথম দেখা মালদ্বীপের তুলনায় বর্তমান মালদ্বীপ, বহুল দৃষ্টিকোণ থেকে যেন ভিন্ন একটি দেশ। ১৯৮৫ সালে মালদ্বীপে একজন বাংলাদেশিও বাস করত না। আজ তিন লাখ মানুষের সে দেশে প্রায় ৮০ হাজার বৈধ ও অবৈধভাবে অবস্থানকারী বাংলাদেশির বাস। ওই দেশে এক লাখ ষাট হাজার বহিরাগত কর্মীর প্রায় অর্ধেকই আমাদের দেশের (এই বছরের মার্চ পর্যন্ত মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি মুলতবি করেছে। কারণ তারা এখন অবৈধ বাংলাদেশিদের একটি পরিসংখ্যান প্রস্তুত করছে)। অর্থাৎ আনুপাতিক হারে তিন লাখ মালদ্বীপবাসীর তুলনায় সে দেশে বাংলাদেশির সংখ্যা দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ। পৃথিবীর কোথাও প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে এই আনুপাতিক হারে অবস্থান করছে না।
১৯৮৫ সালে আমি যখন প্রথম মালদ্বীপ যাই, তখন রাজধানী মালেতে একটি মোটরগাড়িও ছিল না। আজ রাজধানী মালের যানজট কখনো বা ঢাকার যানজটকে হার মানায়। তখন মালদ্বীপ ছিল নিম্ন-আয়ের একটি দেশ। জানুয়ারি ২০১১ থেকে মালদ্বীপ মধ্য আয়ের একটি দেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার বিস্তার সে দেশে ঘটেছে ব্যাপকভাবে। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম আর বরিশালে মালদ্বীপের প্রায় ৪০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই ডাক্তারি পড়ছেন অথবা ডাক্তারিতে ইন্টার্ন করছেন। আমাদের দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ নগণ্য; তবে মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রক্ষণশীল প্রাক্কলনেও প্রতিবছর প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে থাকেন এবং ভবিষ্যতে মালদ্বীপের দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবাহ বাড়বে বই কমবে না।
তাই মালদ্বীপে যখন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, এখন যেমন হয়েছে, আমাদের আগ্রহান্বিত এবং উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যে সে দেশের হালের রাজনৈতিক পরিবর্তন মালদ্বীপের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
আসলে কী ঘটেছে মালদ্বীপে? তিন দশক ধরে সে দেশে মোহাম্মদ গাইয়ুমের স্বৈরশাসনের পর একটি বহুদলীয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে মোহাম্মদ গাইয়ুমকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মালদ্বীপের ৭৭ সদস্যের পার্লামেন্ট অর্থাৎ মজলিসে সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের দল এমডিপির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪। অতএব তাঁকে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হলো। আসলে শুরুতে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমের পিপলস পার্টি ছাড়া প্রায় সব দলই নাশিদের কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়। কিন্তু কোয়ালিশন সরকার পরিচালনায় প্রেসিডেন্ট নাশিদের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা সহজেই প্রতীয়মান হয় এবং সরকার গঠনের দুই মাসের মধ্যেই তাঁর সরকারে চিড় ধরে। অনেক কোয়ালিশন-সহযোগীর সমালোচনার মুখে তিনি পড়েন। মালদ্বীপের বিচার বিভাগে অদক্ষতা ও দুর্নীতি বিরাজ করছিল। আসলে গাইয়ুম নিয়োজিত অনেক বিচারকেরই বিচারক হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ নামের একজন বিচারকের দুর্নীতিপরায়ণতা ছিল সর্বজনবিদিত। কিন্তু বিচার বিভাগে সংস্কার না এনে নাশিদ সেনাবাহিনীকে দিয়ে এই বিচারককে গ্রেফতার করেন। তার ফলে যাঁরা সেই দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকের সমালোচক ছিলেন, তাঁরাও সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের এই বলপ্রয়োগ অপছন্দ করেন। যেখানে নাশিদের উচিত ছিল ধৈর্যসহকারে বিচার বিভাগের সংস্কার করা, সেখানে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে একজন বিচারককে গ্রেফতার করে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তারপর ‘উদারপন্থী’ নীতি অনুসরণ করে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন এবং পর্যটনের উন্নয়নে এমন কিছু পদক্ষেপ (মূর্তি নির্মাণ, অবাধে সুরা আমদানি, ম্যাসাজ পারলার অনুমোদন ইত্যাদি) গ্রহণ করেন, যার জন্য তিনি ইসলামবিরোধী বলে সমালোচিত হন। মূলত এই দুই বিষয়কে কেন্দ্র করেই গত জানুয়ারি মাস থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা তুঙ্গে উঠল ৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন মালদ্বীপ পুলিশের কিছু সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন। রাগে, দুঃখে ও অভিমানে প্রেসিডেন্ট নাশিদ সেদিন তাঁর পদত্যাগ ঘোষণা করেন। রাজনীতি নির্দয়। তাই সেই অবস্থায় মজলিসের স্পিকার কালক্ষয় না করে ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. মোহাম্মদ ওয়াহিদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। এখন অবশ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ বলছেন, অস্ত্রের মুখে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কথা ধোপে টিকছে না।
মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে অবস্থানের কারণে সেই দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রয়েছে কড়া নজর। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহিদ একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন এবং নাশিদের এমডিপিকে মন্ত্রিসভায় চারটি আসন দিতে প্রস্তুত আছেন বলে ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রবার্ট ও’ব্লেকও এমডিপিকে সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার নসিহত করেছেন। ভারতের অবস্থাও তথৈবচ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা এমনই যে চীন, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাও নাশিদের পক্ষে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের এমডিপি তাঁর সমর্থনে রয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আগামী নির্বাচন-সময়, অর্থাৎ নভেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তাপ কমবে না। অবশ্য কমনওয়েলথ দেশগুলোর একটি প্রতিনিধিদল এবং জাতিসংঘের উপসেক্রেটারি জেনারেল মালদ্বীপ সফর করেছেন। এদিকে ডা. ওয়াহেদের সরকার দেশের বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছেন। মালদ্বীপ বোধকরি পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যা শতভাগ মুসলমান-অধ্যুষিত। তবে সাধারণত মালদ্বীপের বাসিন্দারা ধর্মীয় বিষয়াদিতে উদারপন্থী। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নাশিদ এমন কতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে রক্ষণশীল মালদ্বীপ জাতীয় পার্টি এবং আদালত পার্টি সাময়িকভাবে হলেও একটি শক্তিশালী নাশিদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহিদ একজন আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে ঢাকায় ইউনিসেফের পরিচালক ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কাঠমান্ডুতে ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক নিযুক্ত হন। হালে তিনি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে তিনি একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের মতো, মালদ্বীপে হালের ঘটনাবলি সম্বন্ধে স্বাধীন, নিরপেক্ষ তদন্ত করাবেন বলে জানিয়েছেন।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ মালদ্বীপ অতীতেও সহিংস রাজনীতির শিকার হয়েছে। ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে একবার এবং প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের সময়ে ১৯৮০, ১৯৮৩ এবং ১৯৮৮ সালে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার প্রচেষ্টা চলেছে। তবে প্রতিবারই ভারতের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সাহায্যে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম তাঁর আসন আঁকড়ে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু এবার একটি নির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রপতিকে প্রতিবাদের ঝড়ে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হলো। পরিবর্তনটি অসাংবিধানিক নয়, তবে ব্যতিক্রমধর্মী তো বটেই।
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহিদ স্থায়ী প্রশাসনের কাঠামোতে কোনো বড় পরিবর্তন আনবেন বলে মনে হচ্ছে না। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে লন্ডনে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতকে পদচ্যুত করা হয়েছে। কারণ, তিনি সক্রিয়ভাবে এমডিপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিউইয়র্কে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত ‘বিবেকের তাড়নায়’ পদত্যাগ করেছেন এবং বাংলাদেশে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সারিব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।

 ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.