সরেজমিন: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-বহিরাগতদের কাছে শিক্ষার্থীরা অসহায় by শরিফুল হাসান ও নাজমুস সাকিব

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার ছেঁড়ার প্রতিবাদ করায় গত ১৪ আগস্ট ছাত্রলীগের ওপর হামলা চালায় ছাত্রশিবির। এ নিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হলে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকার কয়েক শ বহিরাগত ব্যক্তি এসে জিয়া হলে লুটপাট চালায়। ওই ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের সংঘর্ষময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থীরা।


ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও চরমপন্থীদের অবাধ যাওয়া-আসা, হলগুলোতে শিবিরের আধিপত্য এবং ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা—সেই আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতাদের ‘মহাজোট ছাত্রসংগঠন’ ব্যানারে মহড়া। ফলে যেকোনো সময় সংঘর্ষের আশঙ্কায় দিন কাটছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, সরকারের গত তিন বছরে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত পাঁচবার। এ ছাড়া কয়েক দফায় পদবঞ্চিতদের সঙ্গে মারামারি হয়েছে ছাত্রলীগের। এতে কয়েক দফায় বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে থাকেন আর উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর, কোষাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টাসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ক্যাম্পাসে নয়, থাকেন কুষ্টিয়া শহরে।
বহিরাগত ও চরমপন্থী আতঙ্ক: কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ—এ দুই জেলার ঠিক মাঝখানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এ এলাকায় চরমপন্থীদের দাপট দীর্ঘদিন ধরে। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্যাম্পাসে চরমপন্থীদের প্রভাব ছিল, এখনো আছে। আরও আছে আশপাশের এলাকার বহিরাগত ব্যক্তিরা। অবাধে তারা ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্যাম্পাসের খালেদা জিয়া ও ফজিলাতুননেসা হলের বর্ধিত ভবনের নির্মাণকাজের দরপত্রাদেশ দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পরপরই ২০০৯ সালের এপ্রিলে ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে একটি কাটা মাথা পাওয়া যায়। ঠিকাদার ও ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যই এটি করা হয়। ওই ঘটনার পর গত তিন বছরে ক্যাম্পাসে যত উন্নয়নকাজ হয়েছে, কোনো না কোনো চরমপন্থী সংগঠনকে টাকা দিতে হয়েছে ঠিকাদারদের। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন চরমপন্থীদের কাছ থেকে অস্ত্র নেয় বলেও অভিযোগ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় চরমপন্থীদের অবাধ বিচরণ। তাদের কারণে আমরাও নিরাপদে চলাফেরা করতে পারি না। শিবির এ চরমপন্থীদের কাছ থেকেও অস্ত্র নেয়।’
ক্যাম্পাসের আরেক সমস্যা বহিরাগত। শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো মহড়া বা সংঘর্ষে বহিরাগতদের ব্যবহার করে সব সংগঠন। প্রশাসনও প্রশ্রয় দেয়। বর্তমানে ছাত্রলীগের মধ্যেও অনেক বহিরাগত আছে। অতীতে ছিল ছাত্রদলে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এয়াকুব আলী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের প্রথম অন্তরায় বহিরাগতদের প্রভাব। বহিরাগতদের কারণে সবাই নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। আমরা উপাচার্যকে বিভিন্ন সময়ে বলেছি বহিরাগত ঠেকান। কিন্তু প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবস্থানগত কারণেই এ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দাপট আছে। আমরাও তাদের কাছে অসহায়। তবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। পুলিশ প্রশাসনকেও সব সময় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’
লুটপাটের আতঙ্ক: গত ১৪ আগস্ট পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের সময়েই ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা লুটপাটের শিকার হন।
জিয়া হল ও লালনশাহ হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, রাত নয়টার দিকে সংঘর্ষ কিছুটা কমে এলে স্থানীয় লোকজন এসে বিভিন্ন কক্ষের দরজা ভেঙে শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মুঠোফোন, নগদ টাকাপয়সা, জামাকাপড়, ল্যাপ-তোশক, কাঁথা-বালিশ, জুতা, ব্যাগসহ মূল্যবান জিনিস নিয়ে যায়। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছয়টি হলের প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লুটপাটের যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। ছাত্রদের কম্পিউটার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বহিরাগতরা এসে লুট করে নিয়ে গেছে। ঘটনার পর অনেক গ্রামবাসীর বাড়িতেই ছাত্রদের কম্পিউটার-ল্যাপটপ ছিল বলে আমরা খবর পেয়েছিলাম। আমরা প্রশাসনকে তখন অভিযানও চালাতে বলেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি।’ উপাচার্য এম আলাউদ্দিন বলেন, ওই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শিবিরের দখলে হল: প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে ছাত্রশিবির। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্যাম্পাসের বদলে তারা হলকেন্দ্রিক রাজনীতি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি হলের মধ্যে সাদ্দাম হলটি শিবিরের ঘাঁটি বলে পরিচিত। এ ছাড়া জিয়া হল ও লালনশাহ হলও শিবিরের দখলে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু হলেই বর্তমানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, গত ২৫ অক্টোবর ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের পর সব হল থেকে ছাত্রলীগের কর্মীদের বের করে দেয় শিবির। এর পরে প্রশাসন ছাত্রলীগের নেতাদের হলে ওঠানোর পদক্ষেপ নিলেও তাঁরা ওঠেননি। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় হল দখল নিয়ে আবার সংঘর্ষ হতে পারে।
ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তারেক মনোয়ার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রশাসন সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করে গেছে। আমরাও তা মেনে নিয়েছি।’
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল: নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। ২০১০ সালের ১৯ মে জাহাঙ্গীর হোসেনকে সভাপতি ও শামসুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির বিরোধিতা করে ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবুজর গিফারী ক্যাম্পাসে মহড়া শুরু করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সাত দিনের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। ২০১০ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগের এ দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ সদস্যসহ ১৫ জন আহত হন। আটক করা হয় ১৬ জনকে।
ওই ঘটনার পর ছাত্রলীগের নেতা মাহবুব, খসরু ও আবুজর গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তি, প্রক্টরের পদত্যাগ এবং নবগঠিত কমিটি বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭টি বাসের চাবি নিয়ে নেন। ফলে চার দিন ক্যাম্পাসে কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তির আশ্বাস দিলে তাঁরা চাবি ফিরিয়ে দেন।
ছাত্রলীগের ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে গত বছরের নভেম্বরে বঞ্চিত ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র মৈত্রী মিলে ‘মহাজোট ছাত্রসংগঠন’ গঠন করে। অভিযোগ আছে, মহাজোটের এ পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছেন কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের কয়েকটি চরমপন্থী গ্রুপ। গত ১৯ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে মহাজোটের নেতা-কর্মী ও ছাত্রলীগ আলাদাভাবে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। ওই ঘটনার পর গত ২৪ ডিসেম্বর জাসদ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাইফুজ্জামান ও ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসানকে মারধর করা হয়। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা রয়েছে। উভয় পক্ষই বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিচ্ছে।
কর্মকর্তারা ক্যাম্পাসের বাইরে: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য কোটি টাকা খরচ করে ক্যাম্পাসের ভেতরে বিশাল একটি বাংলো বানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি কুষ্টিয়া শহরে থাকেন। কেবল উপাচার্য নয়, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য প্রক্টরের সব সময় ক্যাম্পাসে থাকার কথা থাকলেও তিনিও থাকেন কুষ্টিয়া শহরে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোনো ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘটনাস্থলে আসতে আসতেই এক ঘণ্টা লেগে যায়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখার কেউ থাকে না। এ বিষয়ে উপাচার্য এম আলাউদ্দিন বলেন, ‘পারিবারিক কারণে রাতে আমি শহরের বাসায় থাকলেও অধিকাংশ সময়ই ক্যাম্পাসে থাকি। ক্যাম্পাসে সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের বাসা নেই। আর কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তক্ষুনি ক্যাম্পাসে আসি।’

No comments

Powered by Blogger.