পবিত্র হজ পালিতঃ ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাতের ময়দান by ফেরদৌস ফয়সাল

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে গতকাল শনিবার পবিত্র হজ পালন করেছেন। হজ ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এবার ২৫ লাখেরও বেশি মুসলমান পবিত্র হজব্রত পালন করেন।
‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক’ (অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার) ধ্বনিতে গতকাল মুখরিত হয়ে উঠেছিল আরাফাতের ময়দান। মক্কা নগর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাত ময়দানের অবস্থান। হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে অবস্থান করা ছাড়া হজ পরিপূর্ণ হয় না। হাজিদের কেউ তাঁবু টানিয়ে, কেউ বা খোলা আকাশের নিচে মাথায় ছাতা ধরে দেশ-জাতি-বর্ণনির্বিশেষে আরাফাতের ময়দানে এক কাতারে অবস্থান করেন।
গতকাল সূর্যোদয়ের পরপরই লাখ লাখ হাজি মিনা থেকে রওনা হন আরাফাতের ময়দানের দিকে। সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের আরাফাতের ময়দানে নেওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক গাড়ির ব্যবস্থা করে। তবে অনেকে হেঁটেই রওনা দেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর মক্কার অদূরে মিনায় লাখ লাখ হাজি সমবেত হন। সারা রাত তাঁরা মিনায় তাঁবুর মধ্যে ইবাদত-বন্দেগি করেন।
সেলাইবিহীন সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র (ইহরাম) পরিধান করা লাখো হাজির স্রোত গতকাল মিনা থেকে যতই আরাফাতের নিকটবর্তী হচ্ছিল, ততই তাঁরা ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের মানসপটে ভেসে উঠছিল সেই ১৫০০ বছর আগে আরাফাতের ময়দানে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণের চিত্র।
গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে হজের খুতবা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা যে মসজিদটি পর্দায় দেখতে পাই, সেটি মসজিদে নামিরাহ। হজের খুতবা এই মসজিদ থেকে দেওয়া হয়। হজের অন্যতম অংশ হিসেবে এ দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজিরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। সৌদি আরবের প্রধান মুফতি আবদুল আজিজ আল শাইখ মসজিদে নামিরাহে খুতবা দেন। হাজিরা খুতবা শোনেন এবং নামাজ আদায় করে নিজ নিজ তাঁবুতে ফেরেন।
হজের দিন আরাফাতে জাবালে রহমত পাহাড়কে দূর থেকে দেখলে মনে হবে ‘সাদা’। কারণ সাদা ইহরাম পরা হাজিরা ওই পাহাড়ে উঠে ইবাদত করেন। তাই দূর থেকে পাহাড়কে মনে হয় সাদা পাহাড়। এই পাহাড়ে একটি বড় উঁচু পিলার আছে। উঁচু পিলারের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ে সিঁড়ি করা আছে, যাতে সিঁড়ি বেয়ে সহজেই চূড়ায় যাওয়া যায়।
হাজিদের যাওয়ার সুবিধার্থে আরাফাতের ময়দানে সৌদি আরব সরকার একাধিক রাস্তা তৈরি করেছে। প্রচণ্ড তাপ থেকে হাজিদের রক্ষার জন্য ময়দানে টানানো হয় হাজার হাজার তাঁবু। এ ছাড়া আরাফাতের ময়দানে অনেকগুলো নিমগাছ লাগানো হয়েছে। রোদে নিমের ছায়া হাজিদের প্রশান্তি এনে দেয় । মক্কা-প্রবাসী বাংলাদেশি মাকসুদ সেলিম জানান, বাংলাদেশ থেকে ওই সব নিমের চারা এনে লাগানো হয়েছে। মরুভূমিতে নিমগাছ পরিচর্যায় প্রতিদিন গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া হয়। আর পানি দেওয়ার কাজগুলো করেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা।
খুতবা শেষে হাজিরা গতকাল আরাফাতের ময়দানে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন। বয়ান শুনে সূর্যাস্তের পর তাঁরা মিনার পথে পাঁচ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বালু ও কংকরময় মুজদালিফা উপত্যকায় যান। তাঁরা মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার করে তাঁরা সেখানে রাত কাটান। এখান থেকে তাঁরা ৭০টি ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করে সূর্যোদয়ের পর মিনার তাঁবুতে ফিরে যাবেন। মিনায় তাঁরা শয়তানের তিনটি প্রতীকী প্রতিকৃতিতে পাথর ছুড়ে মারবেন। এরপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিজ সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যাঁর যাঁর সাধ্যমতো পশু কোরবানি দেবেন হাজিরা।
হাজিরা এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় ফিরে কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ, জমজম কূপের পানি পান, সাফা-মারওয়া পাহাড় সাতবার প্রদক্ষিণ করে মাথার চুল ছেঁটে বা মাথা মুড়িয়ে হজের অত্যাবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। এরপর তাঁরা আবার মিনায় এসে আরও দুই দিন সেখানে অবস্থান করে হজের অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন।
মিনার কাজ শেষে মক্কায় বিদায়ী তাওয়াফ করার পর যাঁরা মদিনায় যাননি, তাঁরা মদিনায় যাবেন। আর যাঁরা আগে মদিনায় গিয়েছেন, তাঁরা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।
এবার ২৫ লাখ হাজির মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭ লাখ এবং সৌদি আরবের সাত-আট লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ হজ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এক লাখ সাত হাজার হাজি।

No comments

Powered by Blogger.