বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কিনতে ৫০০ কোটি টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড

মার্জিন ঋণসহ বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এ জন্য বাজার স্থিতিকরণ তহবিল (মার্কেট স্টাবিলাইজেশন ফান্ড বা এমএসএফ) নামের একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করবে তারা। মার্চেন্ট ব্যাংক ও স্টক ব্রোকার প্রতিষ্ঠান থেকে মার্জিন ঋণ নিয়ে কেনা শেয়ারের বিনিময়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই তহবিলের ইউনিট গ্রহণ করবেন। এসব বিনিয়োগকারীর নেওয়া মার্জিন ঋণের জন্য নতুন করে কোনো রকম সুদ গ্রহণ করা হবে না। একই সঙ্গে এসব ঋণের শ্রেণীকরণপ্রক্রিয়া দুই বছরের জন্য মুলতবি রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হবে।

ফান্ডের ধারণাপত্রের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো একজন গ্রাহক নিজস্ব বিনিয়োগ ও মার্জিন ঋণ নিয়ে ২০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিলেন। বর্তমানে তাঁর পোর্টফোলিওতে থাকা এসব শেয়ারের মূল্য ১০ লাখ টাকা। এখন তাঁর সব শেয়ারের ক্রয়মূল্য ২০ লাখ টাকার সঙ্গে বর্তমান বাজারমূল্য ১০ লাখ টাকার ওপর একটি প্রিমিয়াম ধরে তাঁর পোর্টফোলিওর মূল্য হিসাব করা হবে। প্রিমিয়াম হিসাবের ক্ষেত্রে তাঁর পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের মৌলভিত্তি বিবেচনা করা হবে। ধরা যাক, বর্তমান বাজার মূল্যের ১০ লাখ টাকার ওপর চার লাখ টাকা প্রিমিয়াম ধরা হলো। ফলে ওই বিনিয়োগকারী স্থিতিশীলকরণ তহবিলের মোট ২৪ লাখ টাকা মূল্যের ইউনিট পাবেন।
আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করা হবে। ওপেন অ্যান্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড হওয়ায় এর আকার তিন থেকে চার হাজার বা তারও বেশি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফান্ড গঠনের জন্য একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কম্পানি গঠন করা হবে। মার্জিন ঋণের কারণে যেসব বিনিয়োগকারীর শেয়ার ফোর্সড সেল হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে তাঁরা তার দায় থেকে মুক্ত হবেন। একই সঙ্গে আগামী দিনের সুদের দায় থেকে মুক্তি পাবেন বিনিয়োগকারীরা। এর ফলে বিক্রির চাপ কমে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উদ্যোগে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত যৌথ সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত কম্পানি, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বীমা কম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ব্রোকার-ডিলার, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং উচ্চ আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এই তহবিল গঠনের জন্য স্বাক্ষর করবেন।
মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনের নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পরিষদের এ বৈঠকে এমএসএফ ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এফবিসিসিআই। বৈঠকে দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কম্পানিজের (বিপিএলসি) সভাপতি ও পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
যৌথ সভা শেষে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের সংকটে রয়েছেন। ঋণ নেওয়ার কারণে তাদের পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার শেয়ার বন্ধক রয়েছে। বাজারে দরপতনের কারণে এসব শেয়ারের দর এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, ঋণ আদায়ের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের শেয়ার বাধ্যতামূলক বিক্রি (ফোর্স সেল) করে দিচ্ছে। এতে একদিকে অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ করে মার্জিন ঋণ সমস্যার সমাধান ও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য একটি বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এসব ঋণের শ্রেণীকরণ প্রক্রিয়া দুই বছরের জন্য মুলতবি রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হবে বলে এফবিসিসিআই সভাপতি জানান।
একে আজাদ বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শিগগিরই নতুন করে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া বীমা কম্পানি, দুই স্টক এঙ্চেঞ্জ, বিপিএলসিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ২০০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করবে। ব্রোকার ও ডিলারদেরও শেয়ার কিনতে বলা হয়েছে।
এমএস ফান্ডের ধারণাপত্র তুলে ধরেন বিপিএলসির সভাপতি সালমান এফ রহমান।
ধারণাপত্রে বলা হয়েছে_এমএস ফান্ড গঠনের পর গ্রাহক কিংবা ঋণদাতা মার্চেন্ট ব্যাংক বা উভয় পক্ষ ইচ্ছা করলে মার্জিন ঋণে কেনা শেয়ার এই ফান্ডে স্থানান্তর করতে পারবেন। যেসব গ্রাহক কোনো ঋণ নেননি তাঁরাও তাঁদের পোর্টফোলিও এই ফান্ডে জমা দিতে পারবেন। এর বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে এমএস ফান্ড (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) ইউনিট প্রদান করা হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের হিসাবে থাকা সব শেয়ারের ক্রয়মূল্যের সঙ্গে বর্তমান বাজার মূল্যের ওপর একটি প্রিমিয়াম যোগ করে সেই পরিমাণ টাকার ইউনিট প্রদান করা হবে।
ধারণাপত্রে বলা হয়, যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে কেনা শেয়ার জমা দিতে আগ্রহী হবেন তাদের শেয়ার এমএস ফান্ড নিয়ে নেবে। এর বিনিময়ে তাঁর বিও হিসাবে প্রিমিয়ামসহ নির্ধারিত টাকার সমপরিমাণ ইউনিট জমা হবে। সংশ্লিষ্ট গ্রাহক যেকোনো সময় তাঁর ইউনিট বিক্রি করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে শেয়ার বিক্রির মতোই মার্চেন্ট ব্যাংক তার দেওয়া ঋণ সমন্বয় করে নেবে।
উদ্যোগ গ্রহণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সালমান এফ রহমান বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণ শোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকায় বিনিয়োগকারীরা কম লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে নতুন শেয়ার কিনে গড় ক্রয় মূল্য কমাতে পারছেন না। আবার বাজার কিছুটা বাড়লেই ঋণ আদায়ের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এতে বাজার দ্রুত পড়ে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই মার্জিন ঋণ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফান্ডে শেয়ার হস্তান্তরের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সালমান এফ রহমান বলেন, বহু ধরনের পোর্টফোলিও হস্তান্তরের ফলে তহবিলের ইউনিট হস্তান্তরের পর তার বিনিময় মূল্য বাড়তে পারে। পোর্টফোলিও হস্তান্তর করা না হলে গ্রাহক যে পরিস্থিতিতে পড়তেন তহবিলের ইউনিটের ক্ষেত্রে তার মুনাফার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। কারণ যেকোনো ব্যক্তিগত পোর্টফোলিওর তুলনায় একটি সমন্বিত বাস্কেটে পোর্টফোলিওর সার্বিক নিরাপত্তা হবে অধিকতর নিশ্চিত।
এক প্রশ্নের জবাবে সালমান এফ রহমান বলেন, শুধু একটি উদ্যোগে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে_এমন নয়। এজন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এসইসি উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এর বিপরীতে উদ্যোক্তারা যাতে বাজার থেকে নির্দিষ্ট মূল্য ঘোষণা করে শেয়ার কিনতে পারেন_সেই পদেক্ষপও নেওয়া হচ্ছে। ডিএসইর সভায় এটি অনুমোদন করে এসইসিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সালমান এফ রহমান আরো বলেন, অধিকাংশ কম্পানির মুনাফার পরিমাণ বাড়ছে। মৌলভিত্তিও ভালো। ফলে শেয়ারবাজার নেতিবাচক হওয়ার কারণ নেই। মূলত বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাবই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে শেয়ারবাজার খারাপ হবে। অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েনি। কারণ আমাদের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য নয়। তা ছাড়া বিশ্বের খুব কম দেশই বর্তমানে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম। রপ্তানি আয়ে এ বছর প্রবৃদ্ধির হার ৪৪ শতাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর মুনাফার ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন ঘটছে। তাই বাংলাদেশের শেয়ারবাজার খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই।

No comments

Powered by Blogger.