গান্ধী পরম্পরা টিকবে তো?

খুব বেশি ব্যতিক্রম না হলে রাহুল গান্ধী এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কংগ্রেস পার্টির উত্তরাধিকার রাজনীতির কল্যাণে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। রাহুল গান্ধীও নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করছেন। তিনি ক্ষমতাসীন এ দলটির সাধারণ সম্পাদক। একজন পার্লামেন্ট মেম্বার। সরকারের বড় পদ না নিয়ে বেছে নিয়েছেন দলের যুব শাখাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব। তৃণমূল থেকে নিজেকে গড়ে তোলারই প্রচেষ্টা এটি।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর প্রপৌত্র তিনি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পরিবারই বেশ কয়েকবার সরকার পরিচালনা করেছে। ভারতের বা কংগ্রেসের এ রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র গোটা বিশ্বেই বিরল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হলেও উত্তরাধিকারের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দলটি। বর্তমানে দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। নিশ্চিতভাবেই তিনি তার এ দায়িত্ব অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করবেন না। দলের কাণ্ডারি হওয়ার একমাত্র দাবিদার তার ছেলে রাহুল গান্ধীই। তবে ইতিমধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে_ গান্ধী পরম্পরা টিকবে তো?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। তার অবর্তমানে দল পরিচালনার জন্য সোনিয়া চার সদস্যের একটি কমিটি করেছিলেন। এতে অনেক অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নেতার স্থান হয়নি। কিন্তু রাহুল স্থান পেয়েছিলেন। ওই সময় দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন করছিলেন সমাজকর্মী আন্না হাজারে। তার দুর্বার আন্দোলনে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক সবাই চাচ্ছিল রাহুল দৃশ্যপটে এসে পরিস্থিতি সামাল দিন। কিন্তু রাহুলকে সেভাবে দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে একবার তিনি সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। লিখিত সে বক্তব্য পাঠ করার সময় রাহুলকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। রাহুল পরে তার বক্তব্যকে 'মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া' বলে দাবি করেন। তবে অনেকেরই ধারণা, রাহুল প্রতারিত হয়েছিলেন। কারণ আন্নার অনেক দাবিই সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অনেকের মধ্যে এ মতও রয়েছে যে_ রাহুল নয়, তার বোন প্রিয়াঙ্কারই কংগ্রেসের হাল ধরা উচিত। রাহুলের নেতৃত্বগুণ নিয়ে তাদের মনে সংশয় রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে কংগ্রেস যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল তাতে দেশটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু পার্টি এখন অনেকটাই অধঃমুখী। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট ব্যাংকে টান পড়ছে। সোনিয়ার কল্যাণে বিগত দুটি নির্বাচনে জিতেছে কংগ্রেস। কিন্তু দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষমের কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্রমবর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরোধিতার মুখে পড়তে পারে দলটি। এ রকম প্রেক্ষাপটে দলটির একেবারে ভেতরের সার্কেলে এবং শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠজনরা গান্ধী পরিবারের পরম্পরার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। দিলি্লর ক্ষমতার অলিন্দে, মুম্বাইয়ে ব্যবসায়িক রাজধানীর ময়দানে_ সবখানেই এ নিয়ে সংশয়ের মেঘ দেখা যাচ্ছে। আজকের ভারতে গান্ধী পরিবারের প্রতি সেই আগের মতো শ্রদ্ধা আর দেখা যায় না। এ পরিবারের বিয়োগান্ত ঘটনাবলিও জনমনে আর
তেমন প্রভাব ফেলে না।
রাহুল প্রধানমন্ত্রী হবেন কি-না বা তার সে যোগ্যতা আছে কি-না সেটি প্রশ্ন নয়। তাকে এখানে আসতেই হবে। কংগ্রেসে রাহুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবেই মন্তব্য করেন দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা। তার মতে, দলের ভেতর অনেক গুঞ্জন, অসন্তোষ। এ রকম অসন্তোষ সব সময়ই ছিল। ইন্দিরার সময়ও ছিল, সোনিয়ার সময়ও আছে। গান্ধী পরিবারের কাছের একজন বলেন, সোনিয়া খুব বুদ্ধিমতী নন। কিন্তু তিনি খুবই ধৈর্যশীল। রাহুল খুব আন্তরিক কিন্তু তিনি খুবই গড়পড়তা এক ব্যক্তি।
উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন মার্কিন তারবার্তায়ও রাহুল সম্পর্কে হতাশা দেখা গেছে। ২০০৭ সালের এপ্রিলের ওই তারবার্তায় বলা হয়, ভারতের বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা রাহুলের দৃশ্যত ভুল পদক্ষেপগুলোর ব্যাখ্যা করতে পারেন না। আবার দলের ভেতরের লোকজনের অভিযোগ, রাহুল একজন নবিস। তার ভেতর সে জিনিসটি নেই যা তাকে প্রধানমন্ত্রী করবে। তবে রাহুলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতে রাহুল খুবই বুদ্ধিমান। তিনি বলেন, রাহুল খুব ভালো দাবা খেলেন। এ খেলায় কে জিতল, কেন জিতল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাহুলের এ দিকটি মনে রাখতে পরামর্শ দেন তিনি। কংগ্রেস নেতারাও বলছেন, রাহুলের শুধু একটু সময় দরকার। শিখে নিতে তার সময় লাগবে না। রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধী যখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলটের চাকরি থেকে দল ও সরকারের হাল ধরেন তখন তাকেও অনেক ঝড়ঝাপটা সইতে হয়েছিল। অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম, জাতপাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে এসব আর তেমন কার্যকর নয়। কারও বংশ উপাধিতেও তাদের কিছু যায় আসে না। তারা বাস্তবতার নিরিখেই বিচার করে, নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।

No comments

Powered by Blogger.