রাতের বিমানবন্দরে লাগামহীন হয়রানি by এস এম আজাদ ও রাব্বী রহমান

বুধবার রাত সাড়ে ১২টা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল এলাকা অনেকটাই ফাঁকা। ২ নম্বর আগমনী টার্মিনালের সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন যুবক। টার্মিনাল থেকে লাগেজ-ট্রলি ঠেলে কোনো যাত্রী বের হলেই একসঙ্গে ছুটে গিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরছেন সবাই। 'গাড়ি লাগব? এখানকার গাড়ি। টিকিটও দিমু। কই যাইবেন? আরে, আমার বাড়িও ওই এলাকায়...।' প্রায় একই রকম কথা শোনা যাচ্ছিল সবার মুখ থেকে। এক যাত্রী যাবেন কুমিল্লার দাউদকান্দি। দরাদরি করে এক মাইক্রোবাস চালক গাড়িতে তুললেন তাঁকে। মোহাম্মদ সেলিম নামে ওই যাত্রী জানান, ১২০০ টাকা ভাড়া ঠিক হয়েছে। তবে গাড়িটি কোন এলাকার তা জানেন না সেলিম। মাইক্রোবাসের চালক আবদুর রহিম বলেন, 'আমরা এইখানকারই। তয়, রিসিট লাগে না আমাগো!' কথা শেষ করার আগেই গাড়ি চালু করেন তিনি।

গত বুধবার রাতভর টার্মিনালে অবস্থান করে গাড়িচালকদের মাধ্যমে যাত্রী হয়রানির নানা চিত্র দেখা গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ভেতরেও কম-বেশি হয়রানি চলে। যাত্রীদের নিরাপত্তা ও বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা রক্ষায় নির্ধারিত পরিবহন প্রতিষ্ঠানকে যাত্রী পরিবহনের ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে। বন্দর থেকে যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট টিকিটও দিতে হবে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেল, নিজস্ব যানবাহনে যাত্রী পরিবহন না করেও বাইরের পরিবহনকে ২০০ টাকার টিকিট দিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পরিবহন দালাল-সিন্ডিকেট। টার্মিনাল এলাকায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তৎপরতা থাকলেও তাদের চোখের সামনেই ঘটছে এসব।
অবতরণকারী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, টার্মিনালের ভেতরে আগের তুলনায় হয়রানি কিছুটা কমলেও বাইরের অবস্থা বেশি নাজুক। ভেতরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশির নামে হয়রানি করছেন কাস্টমস ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা। সেখানে মালামাল আটকে রাখা এবং টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনার অভিযোগও মিলেছে।
রাত ১টা। ১ নম্বর টার্মিনালের সামনে দু-একজন যাত্রী বের হয়ে এসেছেন। খালি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ঢুকে বের হয়ে যাচ্ছিল। দুই প্রান্তে এপিবিএনের দুইজন করে সদস্য দাঁড়াতেই দিচ্ছিলেন না কাউকে। তবে টার্মিনালের বের হওয়ার পথে ২ নম্বর টার্মিনালের মতোই গাড়িচালকদের জটলা দেখা যায়। সেখানে কথা হয় আজমীর নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি জানান, ব্রুনাই থেকে ইত্তেহাদ এয়ারলাইনসে করে এসেছেন আজমীর ও তাঁর ভাই রাজু। টাঙ্গাইলের এই যুবক বলেন, বিমান থেকে নামার পর কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কাস্টমস তাঁদের চারটি লাগেজের মধ্যে একটি আটকে দিয়েছে। লাগেজ ছাড়াতে ভাই রাজু আছেন ভেতরে। আর বাইরে অপেক্ষা করছেন আজমীর। ওজন বেশি হওয়ার কারণে আটকাতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি।
বিমানবন্দরে অবস্থানকালে ১ নম্বর টার্মিনালের বাইরে রাত আড়াইটার দিকে আবারও দেখা মেলে আজমীরের। এবার সঙ্গে রাজু। তাঁরা তাড়াহুড়ো করে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে উঠছিলেন। ঘটনা জানতে চাইলে আজমীর বলেন, 'লাগেজ ছাড়া পাইছে। তয় কিছু টাকা লাগছে।' কাকে, কেন এবং কত টাকা দিলেন জিজ্ঞেস করলে আজমীর উত্তর না দিয়েই গাড়িতে উঠে চলে যান।
রাত সোয়া ১টার দিকে টার্মিনাল এলাকা থেকে এক যুবক দুইজনের কাঁধে ভর করে বের হয়ে আসেন। এরপর শুয়ে পড়েন সড়কদ্বীপে। তাঁর স্বজনরা জানান, হাসান মালিথা নামের ওই যুবক অসুস্থ। তিনি এসেছেন মালয়েশিয়া থেকে। কুয়ালালামপুর থেকে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস (এমএইচ ১৯৬) বিমানে রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকায় আসেন তিনি। কোমরের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন হাসান। অসুস্থ হাসান ভেতরে কী ধরনের সহায়তা পেয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, 'সমস্যা হয় নাই। আমার সঙ্গে তো মালই নাই। একজনরে বলিছি আগাইয়া দিতে। তারে ৫০ ট্যাকা বখশিশ দিছি।' কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার বাসিন্দা হাসানকে সারা রাতই টার্মিনালের সামনের সড়কদ্বীপে শুইয়ে রেখে সকালের জন্য অপেক্ষা করেন স্বজনরা।
রাত ২টার দিকে ২ নম্বর টার্মিনালের বের হওয়ার পথে ভিড় করা কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হয় এক প্রতিবেদকের। আলম নামের একজন বলেন, 'ভাই এখন খেপ কম। দূরে না যাইয়া ধারের খেপই মারি। এইখানে যারা আছে বেশির ভাগই বাইরের গাড়ি। তয় নিয়মিত আইয়ে। আমাগো লগে ঠিকাদারগো যোগাযোগ আছে।' দীর্ঘ সময় চালকদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী টানতে দেখা গেলেও কাউকেই পরিবহন কাউন্টারে টিকিটের জন্য যেতে দেখা যায়নি। ২ নম্বর টার্মিনালের সামনে যেখানে চালকদের ভিড়, তার সামনেই বিমানবন্দর মাইক্রোবাস মালিক সমন্বয় পরিষদের নিজস্ব কাউন্টার। এদিকে কয়েকজন চালক গাড়িতে যাত্রী তুলে চলে গেলেও সারা রাত যাত্রী খুঁজতে দেখা যায় দুই-তিনজনকে। চালকরা জানান, এরা দালাল। কথা বলে জানা গেল তাদের একজনের নাম রফিক।
খোকন নামে এক চালক তাঁর প্রাইভেটকারে কুমিল্লার লাকসামের মোদাব্বরগঞ্জের যাত্রী তোলেন ২৭০০ টাকার চুক্তিতে। খোকন বলেন, 'পরিচিত যাত্রী, নিজস্ব খেপে রিসিট লাগে না।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিমানবন্দরের ভেতর থেকে যাত্রী পরিবহনের জন্য গ্রিন বাংলা, বাবা অটোগ্যাস ও বিএম ট্রান্সপোর্ট নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাউন্টার আছে। আর ২ নম্বর টার্মিনালের সামনের কাউন্টারটি মাইক্রোবাস মালিকদের। এই কাউন্টারটি নিয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে মামলা চলছে কর্তৃপক্ষের। কাউন্টারটির সুপারভাইজার মোকলেছুর রহমান বলেন, ঠিকাদারদের নিজস্ব তিন শ পরিবহন আছে বিমানবন্দর এলাকায়। এসব পরিবহনে যাত্রী পরিবহনের সময় রিসিট দেওয়া হয়। সার্ভিস চার্জ বাবদ গাড়ির কাছ থেকে রাখা হয় ১০০ টাকা। তবে ২০০ টাকা করে বাইরের গাড়ির কাছ থেকে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
ঘড়ির কাঁটায় রাত ২টা ৪০ মিনিট। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার পথে একটি লাগেজ গামছা দিয়ে বাঁধছিলেন এক যুবক। কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম সাইদুল। দুবাই থেকে তিন বছর পরে দেশে ফেরা সাইদুলের বাসা রাজধানীর শ্যামলীতে। তিনি এয়ার এরাবিয়া (জি ৯৫১৫) বিমানে রাত দেড়টায় বাংলাদেশে অবতরণ করেন। সাইদুল বলেন, লাগেজ তল্লাশির জন্য স্ক্যানার থেকে নামানোর পরে দেখা যায় তার একটি লাগেজ ভাঙা। বিষয়টি কাস্টমসসহ কর্তৃপক্ষের লোকজনকে অবহিত করা হলে তাঁরা সাইদুলকে জানান মালামাল নামানোর সময় লাগেজটি গাড়ির চাকার নিচে পড়ে ভেঙে গেছে। তবে এতে কোনো মালামাল খোয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
দুবাই থেকে একই বিমানে আসেন কিশোরগঞ্জের আরশাদ মিয়া। তিনি বলেন, যাত্রীদের পূরণের জন্য তথ্য ফরমটি নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। ফরমটি পূরণে দেরি হলেও কেউ তাঁকে সহায়তা করেনি। অনেক সময় পার হয়ে যায় তাতে।
১২টার দিকে অনেকটা ফাঁকা ছিল। রাত ৩টার পর থেকে দোতলায় বহির্গমন ১ ও ২ নম্বর টার্মিনালের ভেতরে ও বাইরে অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড় বাড়তে দেখা যায়। তাদের মধ্যে হজযাত্রীদের একটি দলও আছে। ভেতরে ডলার, রিয়ালসহ বিদেশি মুদ্রা বিক্রি করছিলেন দুই যুবক। কথা হয় একজনের সঙ্গে। নাম জানতে চাইলে বলেন, 'কী লাগবো কন? এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা যাইবো না। এখন ঝামেলা করে।' পরিচয় জানতে চাওয়ার পর টার্মিনাল এলাকায় আর দেখা গেল না ওই দুই যুবককে।
সৌদি আরব থেকে জিএমজি এয়ারলাইনসে (জেড ৫-০৭২) করে রাত ২টা ২১ মিনিটে এসেছেন বাবুল মিয়া। রাত ৪টার দিকে ১ নম্বর টার্মিনালে বেরিয়ে কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা বাবুল বলেন, 'ভেতরে আর আগের মতো পরিবেশ নাই। চেকিং করছে। তবে কেউ কিছু রাখে নাই।' তাঁর মতে, এখন অবস্থা অনেকটা ভালো।
ব্রুনাই থেকে ইত্তেহাদ এয়ারলাইনস (ই ওয়াই ২৫৮) ৩টা ৫০ মিনিটে দেশে এসেছেন আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ৬০ কেজি মালামাল এনেছেন তিনি। তাতে কোনো ঝামেলা হয়নি। একটু বেশি মাল চার্জ দিয়ে আনলেও এখানে এসে বিপদে পড়ার ঘটনা ঘটে অনেকের ক্ষেত্রে। জিএমজির যাত্রী সোহরাব বলেন, 'ভেতরে দালাল আছে। কাস্টমস আটকাইলেও সমস্যা হয় নাই। টাকা কিছু গেছে আরকি...।'
বিমানবন্দরের পরিবহন সেক্টরে এই অরাজকতা থাকলেও তা অস্বীকার করেন বিমানবন্দরে এপিবিএনের সিনিয়র এএসপি সেলিম খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি কমে গেছে। বিমানবন্দর এলাকায় বাইরের চালকদের গাড়ি ভাড়া নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, যাত্রীদের দুর্ভোগ, হয়রানি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনার অভিযোগ আসে। নির্ধারিত পরিবহন থেকে হলে এটা হয় না।' তবে কথার একপর্যায়ে সেলিম খান বলেন, 'এর পরও বিমানবন্দরের পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু লোক বাইরের গাড়িতে যাত্রী তোলে। তবে এমনটি দেখলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।'

No comments

Powered by Blogger.