ইমরুলের লক্ষ্য থাকে নিজের মধ্যেই

ধর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারত ২৭০ রান করল। এরপর আমার আর তোর ওপেনিং জুটিতেই হয়ে গেল ২৩০ রান। আমরা দুজন ভারতীয় খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসছি। ওরা হতভম্ব। কেমন হবে ব্যাপারটা?’
বাস্তবে এমন না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। তার পরও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করলেন ইমরুল কায়েস ও তামিম ইকবাল। তামিমের মুখে কথাটা শুনে হা হা করে হেসেছিলেন ইমরুল।
কিন্তু বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিতে যদি সত্যিই কোনো ওয়ানডেতে ২৩০ রান আসে, সেখানে ইমরুল কায়েসের রান থাকবে কত? প্রশ্নটা আসছে এই কারণেই যে বাংলাদেশ দলের ওপেনিং জুটির প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে ভেসে ওঠে তামিমের মুখ, ইমরুলেরটা পরে।
ইমরুল নিজেও সেটা মানেন। গত বছর ওয়ানডেতে দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন বাংলাদেশ দলের অন্যতম পরিশ্রমী ক্রিকেটার। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুই বছর কাটিয়েও তামিমের ছায়ায় ঢাকা থাকছেন! তবে তামিমের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের কারণে বেশির ভাগ সময় সংযত ব্যাটিংয়ে মনোযোগী থাকতে হয় বলে, ‘ইমরুল মারতে পারে না’ অভিযোগটাকে ছক্কার মতোই উড়িয়ে দিতে চান তিনি, ‘আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক স্ট্রোক খেলতাম। কিন্তু তামিম মারলে আমাকে একটু রক্ষণাত্মক হতে হয়। আমার ভূমিকাটাই এ রকম, উইকেটে থেকে খেলতে হবে। এ জন্য একটু খারাপও লাগে। নিজেকে তখন বোঝাই...এটা আমার কাজ না, তামিমের। ও আউট হয়ে গেলে তো আমাকেই মারতে হবে।’
শুধু স্ট্রোক খেলা নয়, ইমরুল তামিমের প্রতিদ্বন্দ্বী স্লেজিংয়ের জবাব দেওয়াতেও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত হোম সিরিজের কথা। মাঠে কাইল মিলস আর ইমরুল কায়েসের একখণ্ড কথোপকথন পড়ুন:
মিলস: তোমার জন্য তো নাথান ম্যাককালামই যথেষ্ট, আর কাউকে লাগবে না।
ইমরুল: কেন, তুমিও তো আছ।
মিলস: নাহ্, এটা বাজে উইকেট...অত বাউন্সি না।
ইমরুল: কিন্তু আমি যে তোমাদের ওখানে গিয়ে সেঞ্চুরি করে এলাম, তখন তুমি কোথায় ছিলে!
এবার চুপই মেরে গেলেন বেচারা মিলস। এ রকম আরও আছে। যেগুলো টেলিভিশনের পর্দায় না ফুটে উঠলেও প্রতিপক্ষকে চুপচাপ-লাজুক ইমরুলের ভেতরটা দেখিয়েছে।
বিশ্বকাপে অবশ্য ইমরুল ব্যাটেই বেশি কথা বলতে চান। কিন্তু সেই কথাগুলো কেমন হবে তা বের করা গেল। লক্ষ্যের কথা ইমরুল কখনো বলেন না। তবে লক্ষ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি তৈরি। যেসব শটে দুর্বলতা আছে, সেগুলো অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন অনুশীলনে, ‘স্কয়ার কাট, ফ্লিক, স্ট্রেট ড্রাইভ—এই তিনটা শট এখন আমি ভালো খেলি। আগে জানতাম না, তবে এখন বুঝি, সব ব্যাটসম্যানেরই কিছু বিশেষ শট থাকতে হয়। ও রকম এক শটা বল এলে যেন এক শটাই মারা যায়।’
যখন যে শট খেলে আউট হন, পরদিনের অনুশীলনে তাতেই বেশি জোর দেন। ঘাটতি ঢাকতে চান অনুশীলনে বাড়তি পরিশ্রম করে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই জেদ ইমরুলের ছোটবেলা থেকে। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ভালো করেও মেহেরপুর জেলার অনূর্ধ্ব-১৭ দলে সুযোগ পাননি। দলটা রাজশাহী থেকে খুলনা যাওয়ার পথে একই ট্রেনে ছিলেন ইমরুল। ওই ট্রেনে বসেই পণ করেছিলেন একদিন বিভাগীয় দলে খেলতে হবে, যেতে হবে অনেক দূর।
তবে সেই প্রতিজ্ঞার পরিধি বিশ্বকাপ তো নয়ই, হয়তো জাতীয় দল পর্যন্তও বিস্তৃত ছিল না। বিশ্বকাপ তাঁর কাছে তাই স্বপ্নেরও বেশি। ইমরুলের বিশ্বকাপে খেলা একই রকম রোমাঞ্চিত করে তাঁর বাবাকেও, ছেলেকে যিনি আপাদমস্তক ক্রিকেটারই বানাতে চেয়েছিলেন।
ছেলের খেলা নিয়ে বাবা এতটাই আবেগপ্রবণ যে বিশ্বকাপে মাঠে বসে বাংলাদেশের খেলা না দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ‘আম্মা খেলা দেখবেন। কিন্তু আব্বা অনেক আবেগপ্রবণ। আমি আউট হয়ে গেলে হয়তো বা ভেঙে পড়বেন। উনি তাই টেলিভিশনেই খেলা দেখতে চান।্রমাঠে আসতে চান না’—বলছিলেন ইমরুল।
বাবার এই ‘গুণ’টা ছেলের মধ্যেও ছিল। জাতীয় দলে আসার আগ পর্যন্ত রান না পেলে ইমরুলও ভেঙে পড়তেন প্রায়ই। খালি মনে হতো, ‘এখানে রান পাচ্ছি না, কোনো দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললে কী হবে! ওখানে তো আরও জোরে বল আসবে।’ এখন আর এসব কল্পনার বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের হাসি-কান্না ইমরুলের জীবনেরই অংশ। এবার খেলতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপও, যা তাঁর কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু।

No comments

Powered by Blogger.