৩৬ কোটি টাকায় সেজেছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম

লক্কড়ঝক্কড় বাস চলছে যানজটের তীব্র বাধা ঠেলে। যাত্রীকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে জান-প্রাণ দিয়ে প্যাডেল ঠেলেন রিকশাচালক। এর ভেতর দিয়ে সামনে এগোনোর সাধ্য কার! কষ্ট স্বীকার করে পল্টন হয়ে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট পেরিয়ে ডানে মোড় নিন। বিশ্বকাপ-রাজ্যে প্রবেশ!
‘বিশ্বকাপ-রাজ্য’—শুনতে ভালোই লাগছে। কিন্তু এটি এখনো সেই ইলেকট্রনিকসামগ্রীর সাম্রাজ্য। ঠেলাগাড়িতে ডাব বিক্রেতা-দর্শন কমেছে বটে, তবে টিভি-ফ্রিজ কিনে ভ্যানে তুলে বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় ঠিকই আছে। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মশালের নিচে অগুনতি কৌতূহলী চোখ ফটকের ছিদ্রপথে। ভেতরে কী হচ্ছে?
সে এক এলাহি ব্যাপার। ‘বিশাল’ কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি দেওয়ার আগে বলা দরকার, এদিকটায় আসতে এখন আর ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনি সহ্য করতে হয় না। স্টেডিয়ামের আশপাশের রাস্তায় নতুন কার্পেটিং। গাড়ি চলে মসৃণ শব্দ তুলে।
ভালো লাগার এই অনুভূতির উল্টো পিঠে মন খারাপ করার সব উপকরণও যথারীতি বিদ্যমান। ক্রীড়া পরিষদের সামনের রাস্তায় বৈদ্যুতিক তারের স্তূপ দেখা গেছে এক দিন আগেও। বেশির ভাগই জরাজীর্ণ ভবন, তাকানো যায় না। যা ছিরি! সরকার এগুলোকে রং-টং করতে বলেছে শেষ সময়ে। কিন্তু কত দূর কী হবে, সংশয় আছে তাতেও।
সংস্কার...সংস্কার...সংস্কার...চলছেই! এর যেন শেষ নেই। শেষ সময়ে বাতি জ্বালিয়েও কাজ। খেলা শেষ, তবু সংস্কার শেষ হবে না! গ্রামের সেই বিয়েবাড়ির মতো। বর এসে গেটে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু চলছে গেট সাজানোর কাজ!
তবে একটা কাঠামো দৃশ্যমান। বায়তুল মোকাররমের উত্তর ও দক্ষিণ গেট, শিল্পব্যাংক ভবন, হকি স্টেডিয়াম—পুরোনো চারটি ফটকই নতুন করে হচ্ছে। তা-ও যে সে গেট নয়, এগুলোর জন্য বেশ বড় অঙ্ক বরাদ্দ।
বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের বৈশিষ্ট্য—এটির খরচ কোটি টাকার ওপরে, থাকছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পাশেই চার স্তরবিশিষ্ট পানিপ্রবাহের কৃত্রিম ফোয়ারা। আলো-পানির বর্ণিল দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস। চারপাশে ফুলগাছ লাগানোর কথা, কিন্তু এগুলো চোখে পড়ছে না। তবে ‘পাখির অনন্ত যাত্রা’ নামে শিল্পী হামিদুজ্জামানের নকশায় ২৫ ফুট উঁচু ভাস্কর্য উঠে দাঁড়াচ্ছে। ফটকগুলোয় থাকছে আরও কিছু ভাস্কর্য।
এবড়োখেবড়ো পল্টন ময়দান সবুজ রূপ নিয়েছে। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটা পাকা হয়েছে। তবে ক্ষতিও আছে, এই জায়গায়টায় এখন আর খেলাধুলা হতে পারবে না। বড়লোকের বাড়ির আঙিনার মতো ‘ঝকঝকে’ এলাকাটা অনেকের বুকে যেন দীর্ঘশ্বাস।
তবে এটা পুরো এলাকার আসল ছবি নয়। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন ঢাকাকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে ‘তিলোত্তমা’ বানাতে চেয়েছেন, কিন্তু দিন দশেক আগেও তিলোত্তমার ‘ত’-ও খুঁজে পাওয়া কঠিন! উদাহরণ—ক্রীড়া পরিষদ টাওয়ারের পাশেই এখনো নাকে রুমাল গুঁজতে হয় আবর্জনার গন্ধে। ইট, বালু, রডের স্তূপ, থিকথিকে কাদার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি মিললেও এখনো অপরিচ্ছন্ন পুরো এলাকা। ময়লা-আবর্জনা, মাদক বিকিকিনির অভয়ারণ্যও এটি।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকলে অবশ্য ভালো লাগবে। ইউরোপ, ইউরোপ গন্ধ। টিভিতে সুন্দর সব স্টেডিয়াম দেখে আফসোস ঝরে বাঙালির কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ভেতরটা অন্তত সেই আফসোস খানিকটা ঘোচাবে।
গ্যালারিতে চেয়ার, ৫০০ সাংবাদিকের জন্য প্রেসবক্স, কাচঘেরা গোটা দশেক অত্যাধুনিক হসপিটালিটি বক্স, প্রায় ৫০০ জনের জন্য একটি বিশাল ‘আইসিসি বক্স’, সবুজ মাঠ—পরিবেশটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এতে। গ্যালারিতে লাল-সাদা ফুল ফুটিয়ে তুলেছে রঙিন চেয়ার। মাঠের মাঝখানে বিশাল মঞ্চ। এর নিচ থেকে মাটি খুঁড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় দুই শিল্পী দৃশ্যপটে আসবেন বলে খবর।
গত ১২ বছরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মোটা দাগে ৭৫ কোটি টাকার মতো সংস্কারকাজ হয়েছে। ১৯৯৮ মিনি বিশ্বকাপে ৫ কোটি, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২৮ কোটি, গত এসএ গেমসে ৬ কোটি, এই বিশ্বকাপ পর্বে প্রথমে বরাদ্দ ছিল ৩১ কোটি ৬০ লাখ, পরে যোগ হয় আরও ৪ কোটি ১০ লাখ। অনেকে বলেন, বারবার সংস্কারের পেছনে ঢালা এই টাকা দিয়ে ভালো একটা স্টেডিয়ামই বানিয়ে ফেলা যেত।
এসএ গেমসের জন্য যে সংস্কারকাজ হয়েছিল, সেসব ভেঙেচুরে নতুন করে করা হচ্ছে সব। বিশ্বকাপ সামনে রেখে পরিকল্পনা করলে এসএ গেমসের পুরো খরচটা জলে যেত না! এক দিনের কয়েক ঘণ্টার বিশ্বকাপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে আবার ভাঙচুর হবে না তো? সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন নতুন তথ্য, ‘বিশ্বকাপের পর এটিকে আমরা তিনতলা স্টেডিয়ামে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছি।’
তিনতলা হবে কি না পরের কথা। ক্রীড়াঙ্গনে এমন দাবি ওঠেওনি যে এটিকে তিনতলা করতে হবে। বরং পরিবর্তিত এই কাঠামোর কার্যকর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণই ক্রীড়া প্রশাসনের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

No comments

Powered by Blogger.