মাহে রমজানে মাগফিরাতের দশক by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারক আল্লাহ তাআলার বিশেষ করুণা ও দয়ার অপার সুযোগ এবং সমাজের পাপী-তাপী সব মানুষের জন্য এক অনাবিল শান্তি ও চিরস্থায়ী মুক্তির দিশারী। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বিতীয় ১০ দিনকে বলা হয় মাগফিরাতের দশক অর্থাৎ ১১ থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত মাগফিরাত; যার অর্থ ক্ষমা। আর শেষ ১০ দিনকে নাজাতের দশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নাজাত মানে মুক্তি। একটানা ২০ দিন সংযম সাধনার পর রোজাদার এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যান, যেখানে রয়েছে পরম প্রাপ্তি। মর্যাদাপূর্ণ রমজান মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘এটা এমন একটি মাস যে এর প্রথম ১০ দিন রহমতের ঝরনাধারায় পরিপূর্ণ, দ্বিতীয় ১০ দিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য সুনির্দিষ্ট এবং শেষ ১০ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায়রূপে নির্ধারিত। আর যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্থ লোকদের পরিশ্রম ও মেহনত হ্রাস বা হালকা করে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন।’
মাহে রমজানে পূর্ণ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার মুমিন বান্দা আল্লাহ তাআলার প্রতি তাঁর বিশেষ আনুগত্যের অনুপম নিদর্শন স্থাপন করেন। সুবহে সাদিকের আগেই তিনি পানাহার শেষ করেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেন, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যেসব কাজকর্ম করলে রোজা বিনষ্ট হয়ে যাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন রোজাদার তা থেকে বিরত থাকেন, যেসব কাজ সম্পাদন করলে অশেষ সওয়াব পাওয়া যাবে সেসব কাজ বেশি বেশি পালন করেন। সংযম মানে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা নয় বরং যাবতীয় অন্যায় ও জুলুম থেকে সংযত থাকার নাম সংযম বা সিয়াম। মাহে রমজান এ সিয়াম সাধনার উদাত্ত আহ্বান নিয়েই আসে। এমনিভাবে রমজান মাসে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমান নিজেকে আল্লাহ তাআলার একান্ত অনুগত বান্দা হিসেবে পেশ করেন।
মাহে রমজানের প্রতি দিবা-রাত্রিতেই অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং দোয়া কবুল হয়। এ মাসে পারলৌকিক মুক্তি অর্জনের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজাদারের ক্ষমা অবশ্যম্ভাবী, প্রার্থনাকারী ব্যর্থ মনোরথ হবে না। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে ‘মাহে রমজানের প্রতি রাতেই একজন ফেরেশতা ঘোষণা করতে থাকেন—হে পুণ্য অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাচারী! থাম, চোখ খোল। তিনি আবার ঘোষণা করেন, ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করা হবে। অনুতপ্তের অনুতাপ গ্রহণ করা হবে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হবে।’
মাহে রমজানে একজন রোজাদার সারা বছরের নেকি ও পুণ্যের ঘাটতি পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যান। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যবাদিতায় তিনি নিজেকে সুশোভিত করে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন, যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়, অপরাধমূলক চিন্তাভাবনা ও অসৎ কাজকর্ম থেকে বিরত থেকে রমজান মাসে রোজাদার যখন রোজা রেখে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ন্যায়, কল্যাণ ও সৎপথে পরিচালিত হন, তখন মাসের ১০ দিন অতিবাহিত হলে তিনি আল্লাহর রহমত তথা দয়া, করুণা ও অনুগ্রহ লাভে ধন্য হন। অতঃপর যখন এমনিভাবে রমজান মাসের আরও ১০ দিন অতিবাহিত করেন, তখন রহমানুর রাহিম তাঁর গুনাহ খাতা মাফ করে দেন। এরপরও যখন তিনি মাহে রমজানের শেষ ১০টি দিন এভাবে সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন, তখন রোজাদার জাহান্নাম থেকে নাজাত বা মুক্তিযোগ্য হন। এই মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমতের, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত লাভের এবং তৃতীয় ১০ দিন জাহান্নাম থেকে নাজাত প্রাপ্তির।’ (মিশকাত)
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘এই মাসে (রমজানে) চারটি কাজ অবশ্য করণীয়। দুটি কাজ তো এমন যে তার দ্বারা তোমাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হন। আর অবশিষ্ট দুটি এমন, যা ছাড়া তোমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। এই চারটির মধ্যে একটি হলো কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা আর দ্বিতীয়টি হলো অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই দুটি কাজ আল্লাহর দরবারে অতি পছন্দনীয়। আর তৃতীয় ও চতুর্থ হলো জান্নাত লাভের আশা করা ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের প্রার্থনা করা। এ দুটি এমন বিষয়, যা তোমাদের জন্য একান্ত জরুরি।’ (ইবনে খুজাইমা)
এই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের প্রেরণা রমজান মাস এলে তা রোজাদার মুমিন বান্দাদের উদ্বেলিত করে তোলে। এসব মুমিন বান্দার মাগফিরাত ও নাজাতপ্রাপ্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফরমান, ‘যারা রমজানের চাঁদের প্রথম তারিখ থেকে শেষ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছে, তারা সেদিনের মতোই নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে জন্ম দিয়েছেন।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়ে নিষ্পাপ হতে পারল না, তার মতো হতভাগ্য এ জগতে আর কেউ নেই।’
রোজাদারদের মধ্যে এমন অনেক ঈমানদার লোক আছেন, যাঁরা তাকওয়া ও পরহেজগারসম্পন্ন এবং তাঁরা যাবতীয় পাপাচার ও বর্জনীয় কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত সতর্ক থাকেন। তথাপি সিয়াম সাধনার মধ্যে কোনো রকম ভুলত্রুটি হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তাঁরা তওবা ও ইস্তেগফার করে নিজেদের সংশোধন ও ত্রুটিমুক্ত করে নেন। এ শ্রেণীর রোজাদারদের প্রতি রমজান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রহমতের বারী বর্ষণ হতে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনিই (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা-আশ শুরা, আয়াত-১৫)
মাহে রমজানের মধ্যে জাগতিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির বার্তা রয়েছে। ইহকালীন কল্যাণ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই রোজাদার পারলৌকিক শান্তির পথ রচনা করবে। অতএব, রমজানুল মোবারকে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহ লাভ করে ক্ষমা, মুক্তি ও নিষ্কৃতিপ্রাপ্তদের মধ্যে নিজেদের অধিষ্ঠিত করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের একান্ত কাম্য হওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

No comments

Powered by Blogger.