সৌরবিদ্যুৎ কি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে চাই by আসাদউল্লাহ খান

শিল্প বিপ্লবোত্তরকালের প্রধান ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির বিকাশ, কলকারখানা স্থাপন, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগর-বন্দর গড়ে ওঠা। ফলে মানুষের আরাম-আয়েশ বাড়লেও আরেকটি ক্ষতিকর দিক মানুষের কাছে প্রকট হয়ে উঠেছে। তা হচ্ছে ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস অর্থাৎ ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণ। এর কারণে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, খরাসহ বৃষ্টিপাতের ধরন পালটে যাচ্ছে, মানুষ নতুন নতুন রোগের শিকার হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ পৃথিবীর জন্য অশনিসংকেত। রাষ্ট্রের কর্ণধার, বিজ্ঞানী ও শিল্পোদ্যোক্তারা এখন আগের চেয়ে অনেক জোরেশোরে শক্তি উৎপাদনের বিকল্প জ্বালানি তথা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস উৎস খুঁজছেন।
বাংলাদেশে এই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো যেভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই শক্তির উৎসগুলো কতটা মানুষের চাহিদা মেটাতে পারবে, তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। বিদ্যুৎ আজ মানুষের জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং দিনবদলে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এখন পর্যন্ত মানুষের জীবনব্যবস্থায় যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এসেছে, বিশ্বব্যাপী মানুষের চিন্তাচেতনায় প্রযুক্তির বিকাশ যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে, কেবল অফুরন্ত বিদ্যুৎশক্তির উৎস সে দাবি পূরণ করতে পারে। তবে এ কথা সত্যি, বড় বড় শক্তি উৎপাদন কোম্পানি আজ আর বসে নেই। অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণে পরিবেশ যে আজ দূষণের শিকার, এ বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে গেছে, কার্বন-দূষণ যে দুঃসংবাদ ক্রমাগত মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তাতে শিল্পোদ্যোক্তারা বিদ্যুৎশক্তির উৎস হিসেবে তেল, কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে আস্তে আস্তে সরে আসছেন। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো থেকে শক্তি উৎপাদনে তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী, অনেক বেশি তৎপর। বিশ্বের বৃহৎ শিল্প-কারখানার মালিকেরা জীবাশ্ম অর্থাৎ তেল, গ্যাস ও কয়লা থেকে শক্তি উৎপাদনের চেয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যথা সূর্যরশ্মি ও বাতাস থেকে শক্তি উৎপাদনের ব্যাপারে ব্যাপক কর্মোদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে ধনী দেশগুলোতে শক্তি উৎপাদন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎসগুলো থেকে বিশ্বের মোট চাহিদার অর্ধেক শক্তি পাওয়া যাবে। আমেরিকায় সূর্যরশ্মি থেকে এক-দুই গিগাওয়াট (এক গিগাওয়াট = এক বিলিয়ন ওয়াট) বিদ্যুৎশক্তি পাওয়ার কাজ ২০০৯ সালের শেষার্ধে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে নেভাদায় সূর্যরশ্মি থেকে ৩৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ইউরোপের স্পেন ও জার্মানিতে সৌররশ্মি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট স্থাপনের কাজ খুব জোরেশোরে চলছে। স্পেনে আন্ডাসল-১ ও আন্ডাসল-২ নামের দুটো প্রকল্পের আওতায় ৫০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ। আমেরিকায় ২০১০ সালের মধ্যে ২২টি প্রকল্পের অধীনে পাঁচ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অনলাইনে আসবে। আরও আশাপ্রদ ব্যাপার হলো, ফটোভোল্টেইক স্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্রাহকের নাগালে আসছে। এ লাইনে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের ধারণা, ইতিমধ্যে ২১ হাজার মেগাওয়াট গ্রাহকের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার অদূরে টোপাজ সৌর ফটোভোল্টেইক বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মিত হচ্ছে এক বিলিয়ন ডলার খরচে এবং এটা থেকে দৈনিক ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, সৌররশ্মি থেকে দেশের চাহিদার নিরিখে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি কোনো দিন পাওয়া যাবে না। কিন্তু উল্লিখিত দেশগুলোতে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি আমরা দেখছি, তাতে আমাদের এতটা নৈরাশ্যবাদী হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শিল্প-কারখানা স্থাপন, কৃষি উন্নয়ন এবং দৈনন্দিন কাজে বিদ্যুতের ভীষণ ঘাটতি উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে ফেলেছে। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প আজ হুমকির মুখে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার মেগাওয়াট এবং এই বিদ্যুতের প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয় গ্যাস থেকে। এখনো পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ৭০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা গ্যাসের মাধ্যমে মেটানো হয়। কিন্তু গ্যাসের ঘাটতি এক মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এখনো পর্যন্ত দেশে গ্যাসের মজুদ ১৪ টিসিএফ বলে জানা গেছে, যার মধ্যে ৮ দশমিক ৫ টিসিএফ (প্রমাণিত) এবং ৫ দশমিক ৫ টিসিএফ (সম্ভাব্য) মজুদ। এই পর্যায়ে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এবং সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে আট হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে চলতি বছর অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৯০ মেগাওয়াটের সঙ্গে কুইক রেন্টালসহ মোট এক হাজার ১৮২ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। এরপর আগামী বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে নতুন বিদ্যুৎ যুক্ত হবে এক হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট।
এ সবই রূপকল্প, অনেকটা কল্পনার কথা। বাস্তব কথা হলো দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে এ ধরনের অনেক লক্ষ্যমাত্রা অতীতে অর্জিত হয়নি বলে মানুষ এখনো আশায় বুক বাঁধতে পারছে না। আসল ব্যাপারটি হলো, শুধু প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলেই তো কাজ হবে না, মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করছেন—প্রকৌশলী থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ প্লান্টের ঠিকাদার, যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা, সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির মান এবং জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা—সব সময়মতো এবং সঠিকভাবে হলেই বাতি ঠিকভাবে জ্বলবে এবং কলকারখানা চলবে। অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, এ দেশে কোনো সময়ই চুক্তিপত্রের বিধিমালার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ হয়নি এবং চুক্তিপত্রের বিধিমালা বরখেলাপের কারণে ঠিকাদার কিংবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও এ পর্যন্ত কাউকে জবাবদিহি করতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এরপর এই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের ওপর অতিরিক্ত ব্যয় বহন করার যে চাপ পড়বে, তা চিন্তা করলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে হবে। তাই দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থায় দূষণমুক্ত বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে আমাদের যেতেই হবে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা অর্থাৎ সরকারের আগ্রহ এবং একই সঙ্গে প্রচার ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে এ দেশে সৌরবিদ্যুৎশক্তির সংকট মোচনে এক অভাবনীয় ভূমিকা রাখতে পারে। বিদ্যুতের ব্যবহার যত বাড়বে, ইউনিটপ্রতি খরচ যত কমবে, মানুষের জীবন তত আলোকিত হবে, জীবনমান তত উন্নত হবে এবং দেশ সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ মানুষের কাছে সহজলভ্য করাটাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৬ দশমিক ৫ কিলোওয়াট আওয়ার রেডিয়েশন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ২০ লাখ ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর সাফল্য নিয়ে আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশের প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তাদের সৌরবিদ্যুৎ কর্মকাণ্ডের তীর্থভূমি বা পীঠস্থান স্পেন ও জার্মানিতে পাঠাতে হবে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের জন্য। স্পেনে এখন ২২টি প্রকল্পের অধীন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এ বছরের শেষার্ধে এক হাজার ৩৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। পর্তুগালও পিছিয়ে নেই। এ বছরই পর্তুগালের মৌরা পিভি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। জার্মানি, স্পেন ও পর্তুগাল কী ধরনের প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এ সাফল্য লাভ করেছে, তা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে।
আমাদের দেশে বছরের তিন-চার মাস বাদে সূর্যতাপের কোনো ঘাটতি নেই এবং দেশে খাদ্যদ্রব্য, এমনকি সারে যেমন ভেজাল ঢুকে গেছে, সূর্যরশ্মিতে সেটা এখনো ঘটেনি। এখন প্রয়োজন শুধু সরকারের উদ্যোগ, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি দেশবাসীর কাছে সহজলভ্য করার প্রচেষ্টা।
আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
aukhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.